সংযুক্ত প্রথম দুটি স্ক্রিনশট হচ্ছে আমার কুষ্ঠির যথাক্রমে এপিঠ আর ওপিঠ। তালপাতায় পিন দিয়ে খোদাই করে লেখা এই কুষ্ঠির বয়স প্রায় ৫৪ বছর। আমার জন্মের পর-পরই এলাকার জ্যোতিষী বা গণককে দিয়ে আমার বাবা বানিয়ে নিয়েছিলেন এই কুষ্ঠিখানা। এতে খোদাই করে লেখা রয়েছে রাখাইন ভাষায় আমার জন্মের দিন-তারিখ ও সময় তথা রাখাইন সন, চান্দ্রমাসের পক্ষ ও তিথি এবং জন্মবার ও ক্ষণ।
শিশুর জন্মের পর-পরই জ্যোতিষী বা গণককে দিয়ে কুষ্ঠি বানিয়ে রাখাটা রাখাইনদের ঐতিহ্যবিশেষ। বলাবাহুল্য যে, রাখাইনদের ৯৯ শতাংশ কুষ্ঠি কিন্তু তালপাতায় খোদাই করে লেখা। তালপাতাকে নকশা বা খাঁজ করে কেটে তার পর বিশেষ কায়দায় সেলাইপূর্বক তার উপর পিন দিয়ে খোদাই করে লেখা হয় ঠিকুজি। এক পিঠে শিশুটির ঠিকুজি এবং অপর পিঠে ছক কেটে জন্মলগ্নে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের কিছু প্রতীক এবং নকশা আঁকা (পিন দিয়ে খোদাই করা) থাকে। তবে আমার মায়ের কুষ্ঠিখানা ছিল বাঁশের ফালিতে পেরেক দিয়ে খোদাই করে লেখা। যেটির বয়স আনুমানিক ৯৫ বছর (আপাতত হাতের কাছে নেই বলে মায়ের ওই বাঁশের কুষ্ঠিটির ছবি দ্যাখাতে পারলাম না)।
বর্তমান কম্পিউটার যুগে তালপাতা কিংবা বাঁশ দিয়ে কেউ আর কুষ্ঠি বানায় না। রাখাইন সন ও চান্দ্রমাসের পক্ষ-তিথি-বার-ক্ষণসহ খ্রিস্টাব্দের দিন-তারিখও কম্পিউটারে কম্পোজপূর্বক লেমিনেটিং করে ঠিকুজি বানিয়ে রাখে অনেকেই। আমার কুষ্ঠিতে খ্রিস্টাব্দের কোনো মাস-তারিখের উল্লেখ ছিল না। তাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় রাখাইন মাস-তারিখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনুমাননির্ভর খ্রিস্টীয় একটা মাস-তারিখ (৬ মার্চ ১৯৬৬) লিখে দেওয়া হয়েছিল আমার জন্ম-তারিখ হিসাবে। এটাই আমার এসএসসি'র সনদপত্র অনুযায়ী বৈধ জন্ম তারিখ।
তখন আমি ইন্টারের ছাত্র। পড়ছিলাম রাঙামাটি সরকারি কলেজে আর থাকতাম কলেজ-সংলগ্ন হোস্টেলে। রাখাইনদের বর্ষ বিদায় ও বরণ উৎসব 'সাংগ্রেং' উপলক্ষ্যে এক সন্ধ্যায় গ্রামে প্রতিবেশীর বাড়িতে পিঠা বানানো হচ্ছিল। সেখানে আমিও এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেজুরে আলাপে সময় কাটাচ্ছিলাম। আলাপে এক সময় আমাদের সমবয়সীদের বয়স ও জন্মবার প্রসঙ্গ উঠল। তখন এক বড় বোন বললেন যে, আমি নাকি আমায় বয়সীদের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট। এটা আমার মাও আমাকে ইতিপূর্বে একাধিকবার বলেছেন। হারবাং রাখাইন পাড়ার মধুখালি অংশে আমার বয়সী ছেলেমেয়ের সংখ্যা বিশ জনের মতো, তাদের মধ্যে আমার দুই ভাইপো, এক ভাইঝি এবং এক ভাগনেও আছে। ওই বিশ জনের মধ্যে আমিই কনিষ্ঠ। সেই সন্ধ্যায় প্রতিবেশী ওই বড় বোন খুবই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন যে, সেই বছর 'সাংগ্রেং' উৎসবের ঠিক এক পক্ষকাল আগেই নাকি আমার জন্ম।
আমার কুষ্ঠি অনুযায়ী আমার জন্মবার যে বৃহস্পতিবার সেটা আমার জানাই ছিল। তবে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল কি না, সেটা জানতে হলে আমাকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের পুরনো ক্যালেন্ডার খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু প্রায় ১৯ বছরের পুরনো ক্যালেন্ডার খুঁজে পাওয়া তো প্রায়ই অসম্ভব তখনকার দিনে। সেই চিন্তা থেকে গ্রামের বাড়িতে একদিন রাতে সেই বছরের (১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের) ক্যালেন্ডার নিয়ে বসলাম। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দেরটা দেখে-দেখে এবং হিসাব করে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেরটা বানালাম। এভাবে হিসাব করে-করে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯ ... ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যালেন্ডারগুলো বানাতে গিয়ে লক্ষ করলাম যে, সাধারণ বছরগুলো প্রতি ৫ বছর পর (অর্থাৎ প্রতি ৬ বছরে) একবার (যেমন ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ) এবং প্রতি ১০ বছর পর-পর (অর্থাৎ প্রতি ১১ বছরে) দুবার (যেমন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে ২০০২ ও ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ) আর অধিবর্ষযুক্ত বছরগুলো প্রতি ২৭ বছর পর-পর (অর্থাৎ প্রতি ২৮ বছরে, যেমন ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ) হুবহু মিলে যায়। সেদিন ভোররাত পর্যন্ত জেগে থেকে কায়দা করে ১০০ বছরের (১৯৮৫-২০৮৪ খ্রি.) এক পাতার একটা ক্যালেন্ডার বানিয়ে ফেললাম (সেই ক্যালেন্ডারের ছবি খুঁজে পেলে পরে সংযুক্ত করা হবে। তবে বছর পাঁচেক আগে হাতে লেখা সেই ১০০ বছরের ক্যালেন্ডার দেখে ২০০১ থেকে ২০২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৮ বছরের একখানা ক্যালেন্ডার কম্পিউটারে কম্পোজ করে ফেসবুকে স্ক্রিনশট আকারে পোস্ট করেছিলাম, সেটারও [অনন্ত পঞ্জিকা] এককপি এখানে আবার সংযুক্ত করলাম)।
ক্যালেন্ডারখানা বানানোর পর দেখলাম যে, যেহেতু ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৯৪ ... খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ক্যালেন্ডারের হুবহু মিল আছে, তাই ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চের ৬ তারিখটা খুঁজে দেখলাম বৃহস্পতিবারে পড়ে কি না। না, পড়ে না, সে বছর মার্চের ৬ তারিখ কিন্তু রবিবার। প্রতিবেশী সেই বড় বোনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী (আমার জন্ম হয়েছে 'সাংগ্রেং' উৎসবের ঠিক এক পক্ষকাল আগে) আমার জন্ম তারিখ হবে ৩১ মার্চ, যেটা বৃহস্পতিবারে পড়ে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিবছর রাখাইন সম্প্রদায়ের 'সাংগ্রেং' উৎসবের উদ্যাপন শুরু হয়ে থাকে মধ্য এপ্রিলে (১৪ কিংবা ১৫ তারিখ)। রাত জেগে বানানো আমার ১০০ বছরের ক্যালেন্ডার থেকে আমার জন্ম-তারিখ যে ৩১ মার্চ ১৯৬৬, তা এক প্রকার নিশ্চিত হওয়া গেলেও সেদিন আর ১৩২৭ রাখাইন অব্দের 'তেংখুঃ' মাসের শুক্ল পক্ষের ১০মী তিথি (যেটা আমার তালপাতার কুষ্ঠিতে লেখা রয়েছে) একই দিন কি না, তা যাচাই করা তখনও সম্ভবপর হয়নি।
এর প্রায় দেড় দশক পর (২০০০ খ্রিস্টাব্দে) আমাদের জ্যেষ্ঠপুত্রের নাম রাখার জন্য কক্সবাজার শহরস্থ আমার শ্বশুরবাড়িতে এক গণকের শরণাপন্ন হই। তাঁর সংগ্রহে থাকা ৫০ বা ১০০ বছরের একখানা বার্মিজ পঞ্জিকা (গ্রন্থ) দেখে আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চের ৩১ তারিখ আর ১৩২৭ রাখাইন অব্দের 'তেংখুঃ' মাসের শুক্ল পক্ষের ১০মী তিথি (যেটা আমার তালপাতার কুষ্ঠিতে লেখা রয়েছে) একই দিন এবং বারও একই অর্থাৎ বৃহস্পতিবার। এর আরও দেড় দশক পর (২০১৫ খ্রিস্টাব্দে) অ্যান্ড্রয়েড ফোনের একাধিক নির্ভুল অ্যাপসের (১০০ বছর বা অসীম বছরের বার্মিজ ক্যালেন্ডার) মাধ্যমে অধিকতর যাচাইপূর্বক নিশ্চিত হওয়া গেল যে, আমার প্রকৃত জন্ম-তারিখ ৩১ মার্চ ১৯৬৬ (স্ক্রিনশট সংযুক্ত)।
প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্রে ভুল জন্ম তারিখ দেখিয়ে বয়স চুরি করাটা আমার একেবারে অপছন্দের, আমার মতে এটা এক প্রকার অসততা। তবু ভিনভাষার পঞ্জিকার কারণে যথাযথ কনভার্টেড না হওয়ায় আমার প্রাতিষ্ঠানিক জন্ম তারিখ হেরফের হয়ে গেল। তবে অন্যদের মতো কমেনি, বরং বেড়ে গেছে প্রায় এক মাস (২৫ দিন)। একজন চাকুরে হিসাবে এতে আমার আর্থিক ক্ষতি হবে বই কী।
বর্তমান জন্ম-নিবন্ধন যুগেও অনেক মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বয়স চুরি করেন। তবে খুচরো (দিন-মাস) চুরি না, একেবারে পূর্ণাঙ্গ (গোটা বছর) চুরি। তাঁরা তারিখ আর মাস ঠিক রেখে বছরটা বাড়িয়ে দেন, কেউ এক বছর, কেউ-বা দুই বছর (যেমন প্রকৃত জন্মসন ২০০০ হলে তার পরিবর্তে ২০০১ কিংবা ২০০২ লেখা)। আমাদের দুই পুত্রের জন্ম তারিখ আমি একদিনও এদিক-সেদিক করে লেখাইনি, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্রে তাদের প্রকৃত জন্ম-তারিখই লেখা রয়েছে।
সচেতন অভিভাবকদের উচিত এহেন অসৎ ও গর্হিত আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং নিজ-নিজ সন্তানদের সততার পথ বেয়ে বেড়ে উঠতে সুযোগ দেওয়া।