রবিবার, অক্টোবর ০২, ২০১১

কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ 'রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়'

বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্নশিক্ষার হার অধ্যুষিত মফস্বল শহর হচ্ছে কক্সবাজার। পর্যটননগরী কক্সবাজারের গোড়াপত্তন থেকে অদ্যাবধি এই অঞ্চলে শিক্ষার যতটুকু সম্প্রসারণ ঘটেছে তার মুখ্য ভূমিকায় রামু থানার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। কক্সবাজার জেলার (তৎকালীন মহকুমা) সর্বপ্রথম উচ্চ বিদ্যালয় এটি। রামুর তদানীন্তন ধনাঢ্য রাখাইন পরিবারের সন্তান প্রয়াত দানবীর পোয়েজা (বণিক অর্থে) উ-খিজারী এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।

উ-খিজারীর জন্ম (জনশ্রুতিতে) ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন বর্মি তথা রাখাইন ভাষায় একজন সুশিক্ষিত বোদ্ধা। বাংলা ভাষায়ও সমভাবে দক্ষ ছিলেন তিনি। বঙ্গবাসী হিসাবে তাঁর স্বদেশপ্রীতি ছিল অপরিসীম। কর্মজীবনে বণিক হলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তাই তখনকার অন্ধকার যুগেও উ-খিজারী ভাবতে পেরেছিলেন জন্মভূমিকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করবার কথা। তাঁর সেই দূরদর্শিতার ফল হচ্ছে আজকের এই রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।


২.৩৫ একর জমির উপর সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টি নির্মিত হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে ব্যয় হয় তৎকালীন মুদ্রায় ৭০ হাজার টাকা (বর্তমান অর্থাৎ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রায় হিসেব করলে দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা)। এই বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণশৈলীও ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এটি ছিল সম্পূর্ণ সেগুন কাঠের তৈরি। উ-খিজারী সুদূর রেঙ্গুন থেকে সিদ্ধ করা প্রচুর সেগুন কাঠ এবং সুদক্ষ কাঠমিস্ত্রী আনিয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত বৌদ্ধ প্যাগোডা স্টাইলের বিদ্যালয় ভবনটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবেই এটি তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার সর্বপ্রথম স্থাপিত উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করা হলেও বিদ্যালয়ের নথিপত্রে দেখা যায় যে, এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বার এট ল') এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক জনসভায় ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য রাখেন। ফলে বিদ্যালয়টি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পতিত হয়। বিদ্যালয়ের যাবতীয় সম্পদসহ বিদ্যালয়টিকে স্থানান্তর করা হয় মহকুমা শহর কক্সবাজারে। বর্তমানে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের পূর্ব দিকে অবস্থিত জরাজীর্ণ কাঠের বেড়া ও টিনের ঘরটিই রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি ভগ্নাংশ।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের কাঁপন লাগে বিশ্বব্যাপী। তার অভিশাপ থেকে রেহাই পায়নি প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বিদ্যালয়টি। সামরিক বাহিনীর লোকেরা হুকুমদখল করে নেয় বিদ্যালয় ভবন এবং বিদ্যালয়ের মাঠ হয়ে ওঠে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ কেন্দ্র। ফলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা বর্তমান রামু চৌমুহনীর বাস স্টেশনসংলগ্ন দাঅং (বানানভেদে দং) দীঘির পূর্ব দিকে একচালাবিশিষ্ট একটি খড়ের ঘরে বেশ কিছুদিন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই বিদ্যালয়টির উপর একদিন নেমে এল বিরাট বিপর্যয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ। দুর্ঘটনাজনিত এক অগ্নিকাণ্ডে এই বিদ্যালয়টি ভস্মীভূত হয়ে যায় সম্পূর্ণভাবে। রামুবাসীর জন্য এই অপ্রত্যাশিত দৈবদশা চরম আঘাতের বেদনা বয়ে আনলেও সে বেদনায় মুহ্যমান হয়ে থাকেনি রামুবাসী। সর্বস্তরের জনগণ তাদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রসারিত করেছিল সাহায্যের হাত। মরহুম জাফর আলম চৌধুরীর প্রচেষ্টায় তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা অনুদান দিয়েছিলেন ২৫ হাজার টাকা (তৎকালীন মুদ্রায়)।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টি পুনঃনির্মাণের সময় ১২ কক্ষবিশিষ্ট ১৩৮ ফুট দীর্ঘ ও ২৮ ফুট প্রশস্ত একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ২ কক্ষবিশিষ্ট ৫০ ফুট দীর্ঘ ও ২৭ ফুট প্রশস্ত আরও একটি দ্বিতল ভবন এবং ৮২ ফুট দীর্ঘ ও ৩৬ ফুট প্রশস্ত একটি মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়।

রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভাঙাগড়ার ইতিহাসে প্রয়াত পোয়েজা উ-খিজারীর পর যাঁদের অবদান স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে মরহুম মেহের আলী বিএল অন্যতম। বিদ্যালয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যা করেছিলেন আজকাল তেমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও একক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক স্থানান্তরিত এই বিদ্যালয়টি উ-খিজারী প্রদত্ত যথাস্থাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আজও তিনি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে সম্মানিত ও স্মরণীয়। মরহুম মেহের আলী সাহেবের জীবদ্দশায় তাঁর এই মহান কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির এক সভায় জনৈক সদস্য বিদ্যালয়টিকে 'খিজারী-মেহের আলী উচ্চ বিদ্যালয়' নামকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করলে মেহের আলী স্বয়ং তৎক্ষণাৎ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, 'খিজারী বিদ্যালয়, খিজারী বিদ্যালয়ই থাকবে। খিজারীর নামের পাশে কারও নাম থাকতে পারে না।' তাঁর এই উক্তি তাঁর সাচ্চা হৃদয়ের নির্লোভ উদারতা ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মরহুম মেহের আলীর পর যাঁর অবদান স্মরণীয় তিনি হলেন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য মরহুম জাফর আলম চৌধুরী। রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামগ্রিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মরহুম জাফর আলম চৌধুরী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ বিদ্যালয়টি অপ্রত্যাশিত অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে গেলে তিনি বিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খানকে সশরীরে আমন্ত্রণ করে এনে বিপর্যস্ত বিদ্যালয়ের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন। যে কারণে প্রত্যক্ষদর্শী গভর্নর তৎক্ষণাৎ জরুরিভিত্তিতে ২৫ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদ্যালয়টি কেবল ৪ জন শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত হত। এই ৪ জন শিক্ষকের মধ্যে একমাত্র স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক ছিলেন বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অতিবাহিত করেছেন। অগ্নিকাণ্ডের পর বিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় মরহুম রশিদ আহমদ মাস্টার ও বিদ্যালয়ের দপ্তরী আতর আলীসহ বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনেক অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। শিক্ষকতার মহান ব্রতে নিবেদিত থেকে বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া জ্ঞান বিতরণ করেছেন জন্মভূমিকে অশিক্ষার অন্ধকার অতল থেকে সুশিক্ষার আলোর অভিমুখী করার স্বপ্নসাধনায়।

এই বিদ্যানিকেতনের শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে অনেকে অকাতরে দান করে গেছেন অবৈতনিক শিক্ষকতার মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম উল্লেখের দাবি রাখে তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, উ-মংক্যজ, মাস্টার ফরিদুল আলম, অধ্যাপক দীপক বড়ুয়া, মনমোহন বড়ুয়া, দয়াল হরি শর্মা, জুবায়ের আলম, জহিরুল আলম, অধ্যাপক শাহজাহান মনির প্রমুখ। এ ছাড়া যে দু'জনের কথা স্বীকার না করলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনায় ত্রুটি থেকে যাবে, তাঁরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক মরহুম রশিদ আহমদ ও দপ্তরী আতর আলী।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি সুদক্ষ, অভিজ্ঞ ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন জ্ঞানীগুণীদের অসাধারণ মেধায় পরিচালিত হয়ে আসছে এই বিদ্যালয়টি। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মতো জ্ঞানীর পরশে ধন্য হয়েছে এই বিদ্যালয়। এ ছাড়া আলতাফ মিঞা, শশীভূষণ ভট্টাচার্য, ব্রজমোহন সাহা, রমেশচন্দ্র গুপ্ত, আলী আহমেদ, নিকুঞ্জবিহারী নন্দী, জহির উদ্দিন, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী, ফজলুর রহমান, বিভূতিভূষণ সেন, কাসেম আলী, শেখ আবু আহমেদ, সুরেশচন্দ্র দেব, মমতাজউদ্দিন আহমদ, জাকেরউল্লাহ্, মাহমুদুল হক, অমরনাথ ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ আমির, আক্তার আহমদ ও নন্দিত সংগীতজ্ঞ জগদানন্দ বড়ুয়ার মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বরা শিক্ষাক্ষেত্রে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবদানকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছুতে অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে অদ্যাবধি জাতীয়করণ করা হয়নি।

[লেখাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় বাংলা দৈনিক 'সংবাদ'-এর ২৯ এপ্রিল ১৯৯৩ (মোতাবক ১৬ বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ) তারিখের সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি রামুর সাহিত্যসেবী আশীষ কুমার এবং আমি যৌথভাবে তৈরি করেছিলাম। এখানে হুবহু কম্পোজ করে তুলে দেওয়া হল।]

কোন মন্তব্য নেই: