আবদুল হক চৌধুরী |
[২৬ অক্টোবর ছিল চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস। তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা -র ১০ নভেম্বর ১৯৯৪ তারিখের সংখ্যায় আমি তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি তাঁর প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ এখানে হুবহু তুলে দিলাম।]
২৭ অক্টোবর ১৯৯৪, বৃহস্পতিবার বিকালে বেতার ভবনের বার্তা কক্ষে গিয়ে সেদিনের দৈনিক আজাদী পত্রিকাটি পড়ার জন্য চোখের সামনে মেলে ধরলাম। প্রথম পৃষ্ঠার এক জায়গায় আমার চোখ আটকে গেল। বড়-বড় অক্ষরে লেখা চট্টগ্রামের খ্যাতিমান গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আর নেই। হেডিংটা পড়েই কতক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলাম বলতে পারব না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি মুচড়ে উঠল। পরে প্রকৃতিস্থ হয়ে পুরো নিউজটা পড়লাম। পুরো নিউজটা পড়ে বুঝলাম ততক্ষণে তাঁর মৃতদেহ দাফন করা হয়ে গেছে। একটুও জানান না দিয়ে প্রচার বিমুখ গুণীব্যক্তিটি এভাবে চলে গেলেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বই-কী। সেদিন নানা ব্যস্ততার কারণে বিকাল অবধি কোনো দৈনিকই পড়ে হয়ে ওঠেনি। আমার আফশোস, সকালেও যদি জানতাম তা হলে ডিসি রোডস্থ মনীষা -য় না হোক অন্তত মহসিন কলেজ মাঠে হলেও তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে পারতাম। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে পারলাম না, এ দুঃখবোধ চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।
মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১-এর মাঝামাঝি সময়ে। পরিচয়ের মাধ্যম ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের প্রাক্তন উপ-মুখ্য প্রযোজক ও আমার অগ্রজপ্রতিম প্রয়াত উ চ নু (উ বা)। পরিচয়ের পর থেকে আরাকান বিষয়ক গ্রন্থ ও তথ্যের প্রয়োজনে তিনি ডিসি রোডস্থ আমার বাসায় মাঝে-মধ্যে আসতেন। আমিও তাঁর বাসভবন মনীষা -য় যেতাম মাঝে-মধ্যে। তখন আমার সঙ্গে থাকতেন মিরসরাই ডিগ্রি কলেজের (তৎকালীন) প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) মং উ সাং। আমি এবং প্রভাষক মং উ সাং আরাকানের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকে মাঝে-মধ্যে লিখে থাকি। তাই মরহুম আবদুল হক চৌধুরী ও আমাদের দু'জনের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক হতে বেশিদিন লাগেনি। মরহুম চৌধুরীর লেখা চট্টগ্রাম নামের নতুন উৎস এবং চেরাগী পাহাড় নামের নতুন উৎস শীর্ষক নিবন্ধ দু'টির তথ্যপঞ্জিতে প্রয়াত উ চ নু (উ বা) এবং প্রভাষক মং উ সাঙের নাম উল্লেখ রয়েছে। তাঁর রাউজান নামের নতুন উৎস নিবন্ধটি লেখার সময় তাঁকে আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জোগান দিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, মরহুম আবদুল হক চৌধুরী আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন, বয়সে তিনি আমার প্রয়াত জনকের কাছাকাছি। তাই তাঁকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। জীবদ্দশায় তিনি যতবার আমার বাসায় এসেছিলেন, প্রত্যেকবারই আসতেন খুব ভোরে। এসে নীচ থেকে মং হ্লা, মং হ্লা কিংবা পিন্টু, পিন্টু বলে ডাকতেন নয় তো সরাসরি উপরে এসে দরজায় নক করতেন। একবার খুব ভোরে (দিনটা ছিল সম্ভবত একুশে ফেব্রুয়ারি) এসে বললেন, চলো, তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব । তাঁর কথানুযায়ী তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরোলাম। নিয়ে গেলেন আলমাস সিনেমা হলের কাছে এক বাসায়। ওটা ছিল খ্যাতিমান চিত্রকর মুর্তজা বশীরের বাসা। সেখানে শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীরের সংগৃহীত দু-একটি আরাকানি (পঞ্চদশ শতকের) মুদ্রার গায়ে উৎকীর্ণ আরাকানি তথা রাখাইন লিপির পাঠোদ্ধার করতে হল আমাকে।
পরিশ্রমী গবেষক মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর লেখা বেশ ক'টি দীর্ঘ নিবন্ধের কপি করে দিয়েছিলাম আমি বাংলা একাডেমী পত্রিকা -র জন্য। তা ছাড়া বাংলা একাডেমী থেকে সদ্য প্রকাশিত তাঁর প্রচীন আরাকান: রোয়াইঙ্গ্যা, হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী গবেষণা গ্রন্থে যতগুলো আরাকানি বৌদ্ধ তথা রাখাইন রাজার নাম রয়েছে সেগুলোর (পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার আগে) সঠিক বানান (রাখাইন উচ্চারণ অনুযায়ী) লিখে দিয়েছিলাম। বছর দুয়েক আগে আমার প্রয়োজনে কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থটা দু-একদিনের জন্য ধার চাইতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসভবনে অর্থাৎ মনীষা -য়। সেদিন আমাকে বললেন যে, রাখাইন সম্প্রদায় সম্পর্কিত তিনটি লেখা তাঁর প্রয়োজন। লেখাগুলো হচ্ছে-- জন্ম, বিয়ে এবং মৃত্যু সম্পর্কিত। তন্মধ্যে ইতিপূর্বে একটা মাসিকে প্রকাশিত রাখাইন সমাজে বিয়ে শীর্ষক আমার লেখাটা তিনি সংগ্রহ করেছেন বলে জানালেন। বাকি রইল জন্ম এবং মৃত্যু অর্থাৎ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কিত দু'টি লেখা। লেখা দু'টি শীঘ্রই তৈরি করে দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে তাগাদা দিলেন। তাঁর কথানুযায়ী আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং মাউইয়ের (মাসি) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে রাখাইনদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শীর্ষক লেখাটি তৈরি করলাম এবং একটা দৈনিকে পাঠিয়ে দিলাম। পরে ওই পত্রিকার ফোটোকপি তাঁর অর্থাৎ মরহুম চৌধুরীর কাছে দিয়ে এলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি বলে রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্ম বিষয়ক লেখাটা এতদিন তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি আমি এ সম্পর্কিত সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। কিন্তু লেখাটা তৈরি করার আগেই তিনি অকস্মাৎ চলে গেলেন। একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর প্রয়োজনেই আমি লেখাটা তৈরি করতে চেয়েছিলাম। এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভসঞ্চার থেকে শুরু করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় রীতিনীতির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নোট করে রাখলাম। কিন্তু লেখাটা ছাপানো আকারে তাঁর হাতে তুলে দিতে পারলাম না। এ অপারগতা আমাকে চিরদিন খোঁচা দেবে।
শ্রদ্ধেয় আবদুল হক চৌধুরী আলাপকালে প্রায়ই বলতেন যে, আমাদের অর্থাৎ আমি এবং প্রভাষক মং উ সাঙের সঙ্গে অন্তত আরও পাঁচ বছর আগে পরিচিত হলে ভালো হত। তা হলে আরাকানের ইতিহাস আরও তথ্যসমৃদ্ধ এবং বিস্তারিত আকারে লিখতে পারতেন। আমাদের সঙ্গে আরও আগে পরিচিত না হওয়ায় তিনি সবসময় আক্ষেপ করতেন। মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে একটা সংকলনের সৌজন্য কপি পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর বাসভবনে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সেদিন বললেন, আমার হার্টের অসুখ। কয়েকদিনের মধ্যে ভারত যাব, চিকিৎসা করানোর জন্য। তার পর ফিরে এসে কক্সবাজার যাব। কক্সবাজারে গিয়ে প্রত্যক্ষ করব তোমাদের (অর্থাৎ রাখাইনদের) সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণ । কিন্তু তাঁর আর কক্সবাজার যাওয়া হল না।
স্কুল জীবনে তাঁর গ্রন্থের (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি) সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর ওই গ্রন্থ পড়েই আমি আমার পিতৃভূমি আরাকান সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানি। পরবর্তীতে তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ সংগ্রহ করেছি এবং পড়েছি। অস্বীকার করব না, আরাকানের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন এবং লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে মরহুম আবদুল হক চৌধুরী অন্যদের তুলনায় বহুগুণে নিরপেক্ষ। তাই আমি প্রয়োজনে তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকি।
ব্যক্তি আবদুল হক চৌধুরী আজ আমাদের মাঝে নেই তা সত্য। কিন্তু তাঁর পরিশ্রমের ফসলগুলো আমাদের বুক-শেলফগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। তিনি তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।
২টি মন্তব্য:
নিয়মিত লিখছেন না কেন ?
আগে নিয়মিত লিখতাম। এখন বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে ...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন