সোমবার, অক্টোবর ২২, ২০১২

আমাদের গড় মানসিকতা, মানবিক মানুষ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা

ঘটনা ০১

সেদিন সহধর্মিণীর সাথে কথা বলছিলাম সেলফোনে। কথোপকথন চলছিল আমাদের (রাখাইন) মাতৃভাষায়। সেলফোনের মাধ্যমে বলা আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আমার সামনে বসা বাঙালি ভদ্রলোকটি। কথোপকথন শেষ হওয়ার পর তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন,
  • কী ভাষায় কথা বললেন দাদা, একটা শব্দও বোধগম্য হয়নি।
  • আমাদের মাতৃভাষায়, মানে রাখাইন ভাষায়।
  • বাংলায় বললে কী অসুবিধে ছিল দাদা? 
  • আমি তো আপনার সঙ্গে বাংলায় বলছি। কিন্তু যাঁর সাথে এতক্ষণ সেলফোনে কথা বললাম, তিনিও আমার মতো রাখাইন। সুতরাং, নিজেদের মাতৃভাষায়, মানে রাখাইন ভাষায় কথা বলাই তো যুক্তিসংগত।
  • না, মানে বাংলায় বললে আমরাও বুঝতে পারতাম আর কি …

 
ঘটনা ০২

বছর পনেরোর আগে আমার শ্যালিকা ও তার বান্ধবীদের নিয়ে কক্সবাজার শহরের পর্যটন মোটেল শৈবাল-এর পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের ফাঁকে-ফাঁকে ফোটো সেশন করছিলাম, একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জন্য। শ্যালিকা ও তার বান্ধবীদের ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাক দেখে সেখানে উপস্থিত দেশি এক পর্যটক জানতে চাইলেন,
  • মেয়েদের পোশাক এ রকম কেন দাদা?
  • রাখাইন মেয়েরা তো এ ধরনের পোশাকই পরে।
  • শাড়ি পরলে আরও সুন্দর দেখাত।
  • কেন, শাড়ি পরতে যাবে কেন তারা?
  • বাংলাদেশে বসবাস করছেন যখন, শাড়ি পরলে অসুবিধে কী দাদা? আমরা তো সবাই বাঙালি …
  • না, আমরা বাঙালি নই। কারণ, নিজেদের (সম্প্রদায়ের) মধ্যে আমরা বাংলায় কথা বলি না। তবে বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমরা বাংলাদেশি। 

 
ঘটনা ০৩

বছর দুয়েক আগে এক বিদেশি কোম্পানির উৎপাদিত জুতায় গৌতম বুদ্ধের ছবি ব্যবহার করায় এর প্রতিবাদ স্বরূপ একটা লেখা লিখেছিলাম তিনটে বাংলা কমিউনিটি ব্লগ সাইটে। সেখানে বিশেষ তিন-চারজন ব্লগারের মন্তব্য ছিল নিম্নরূপ:
  1. জুতায় কারও (বুদ্ধ) ছবি লাগালে যদি ভঙ্গুর ধর্ম ভেঙে যায়, তা হলে ধর্ম পালন না করাই উত্তম।
  2. ধার্মিকদের ধর্মানুভূতি (নারী) সতীচ্ছদের মতোই ভঙ্গুর ... এখানে কীভাবে বৌদ্ধ ধর্ম বা বুদ্ধকে অবমাননা করা হল, বুঝিয়ে বলবেন কি?
  3. জুতায় ছবি অবমাননার উদ্দেশ্যে দেয়নি, ব্যবসার উদ্দেশ্যেই দিয়েছে ... ওনারা কোনো ভুল করেননি, জুতা বানানোর স্বাধীনতা সবার আছে।
  4. ... কিন্তু এটা (বৌদ্ধ ধর্ম) কি কোনো ধর্ম (হল)? ঘরবাড়ি ছাড়া একজন সন্ন্যাসী ধর্মের প্রবর্তক হয় কীভাবে? জীবনমুখিতা কি কোনো ধর্ম? তার প্রবর্তিত ধর্মের আইডিওলজি কী, বলুন তো দেখি ...

উপরে যাঁদের সংলাপ ও মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা সবাই প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত। শুধু শিক্ষিতই নন, বলা উচিত উচ্চশিক্ষিত। আর উচ্চশিক্ষিতরা যদি এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন, তা হলে স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মানসিকতা কী রকম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

আসলে ব্যক্তি মানুষের মানসিক গঠন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারাই উৎকর্ষতা লাভ করে না বা পরিপূর্ণতা পায় না। মানুষের বেড়ে ওঠার পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশই একজন মানুষকে মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে বলে আমার ধারণা এবং বিশ্বাস। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বিদ্যমান সার্বিক পরিবেশ কিন্তু ব্যক্তি মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের সহায়ক নয় মোটেই। আর এই বিরূপ পরিবেশের মধ্য থেকে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ আপনা-আপনি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে, এই আশা করাটাও বাতুলতা মাত্র।

অন্যের কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস বা আনুষঙ্গিক উপাচার ইত্যাদিকে ছোট কিংবা হেয় করে দেখার এই মানসিকতা কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। এ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠেছে মূলতঃ গণ্ডিবদ্ধ চর্চার কারণে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চাইলে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেবল লালন আর চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এসবের সমান্তরাল অধ্যয়নও করে যেতে হবে। অন্যের ধর্ম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের প্রয়োজন আরও বেশি। বর্তমান অভিভাবকরা হচ্ছেন সেই প্রজন্ম, যাঁরা কেবল চর্চাই করেছেন, কিন্তু অধ্যয়ন করেননি। তাই পূর্বসূরিদের এই সংকীর্ণ মানসিক গঠন নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা যেন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে না বসে সেদিকে খেয়াল রাখার সময় বোধহয় আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি। আরও দেরি করলে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, সেসব তিলে-তিলে ধ্বংস হয়ে জাতি একদিন সম্মিলিত ও স্বকীয় চেতনাহীন হয়ে পড়বে। তখন জাতি কী নিয়ে আর গর্ব করবে?

লেখাটা শেষ করছি আমার সাম্প্রতিক একটা স্ট্যাটাস দিয়ে, আমরা যারা সচেতন বলে দাবি করি, তারা যদি কথায় ও কাজে মিল রেখে সততা এবং সৎ সাহস নিয়ে নিজ-নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করি, তা হলে এ নষ্ট সমাজ একদিন উঠে দাঁড়াবেই। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ...

কোন মন্তব্য নেই: