সোমবার, নভেম্বর ৩০, ২০০৯

ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী লে. কর্নেল (অব.) ডালিমের কানাডা সফর

ঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম সম্প্রতি কানাডা থেকে ঘুরে গেছেন। তিনি বহন করছেন ব্রিটিশ পাসপোর্ট । এই পাসপোর্টের সুবাদেই ডালিম ঘুরে বেড়াচ্ছেন নানা দেশ। এ কারণেই যে-কোনো সময় যে-কোনো দেশ ভ্রমণ করতে পারছেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পর ৪ নভেম্বর ডালিমসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একটি বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া একটি বিমানে তাঁদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন এই ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ চাকরিতে যোগ দিতে রাজি হননি। তাঁরা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এঁদের মধ্যে লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমকে চীন দূতাবাসে প্রথম সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব এবং ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পোল্যান্ডে ডালিমকে একই পদে নিয়োগ দিলেও সেদেশের সরকার তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
পরবর্তীতে এরশাদ সরকার ডালিমকে বেইজিঙে নিয়োগ দিতে গিয়ে না পেরে পরে হংকঙে ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেন।

বিস্তারিত পড়ুন এখানে।

শনিবার, নভেম্বর ২৮, ২০০৯

আমার পাঁচখানা কবিতা


পাশাপাশি, না মুখোমুখি?

 

রক্ত কিংবা নৃতাত্ত্বিকসূত্রে
তুমি আমার নিকটজন বই কী
তবে আমার আত্মার আত্মীয় সেই
মনন আর জীবনাচরণে যার অবস্থান উত্তরে
তাই বলি, ভেবে দ্যাখো
সাম্য ও প্রগতির মানদণ্ডে
তোমার যাপিত জীবন তোমাকে কোন শিবিরে দাঁড় করায়
শোষক, না শোষিতের?
অতএব, দেখতে আমার মতো হলেও
তারা সবাই আমার স্বজন নয়
কিংবা অন্যরকম দেখালেও
চেতনায় তারা সবাই দূরের নয়


 

কাঙ্ক্ষিত মধ্যাহ্ন

 

ইংরেজের জানালা দিয়েও নয়
বাঙালির ভেন্টিলেটার দিয়ে তো নয়ই
কেবল অগ্রজের কলম দিয়েই আমি দেখি
আমার পিতার সমস্ত কিছু
তার প্রতিকৃতির উপর ওই আবরণ
কুয়াশার নয়, নিরেট কালো বস্ত্র
জননীকে কণ্ঠে ধারণ করে
‘ম্রাউক্উ-ওয়েথালি-ধাঞাওয়াডি’-তে আমি
বিচরণ করি প্রতিনিয়ত
এবং এভাবেই আমি পৌঁছে যাব
ঐতিহ্যের রাজপথ দিয়ে
কাঙ্ক্ষিত সেই রৌদ্রোজ্জ্বল মধ্যাহ্নে
[‘ম্রাউক্উ-ওয়েথালি-ধাঞাওয়াডি’: আরাকানের তিন রাজধানীর নাম]

 

বদলায় না দিন

 

বোধের খোরাক ফেরি করি দিনমান
খাই অখাদ্য, উগরাই উপাদেয়
চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়
এসব উদরস্থ করে
দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান তারা
তৃপ্তির ঢেকুর তোলে
অন্যের মাথার উপর
কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া তাদের স্বভাব
আমি এবং আমার মতো মানুষদের
দিন যায়, বছর ঘোরে, এভাবে
যুগ অতিক্রান্ত হয়, শতাব্দি এগোয়
তবু বদলায় না দিন

 

পার পাবে না

 

শব্দমালায়
আবরণ নয় আভরণই শ্রেয়
উলঙ্গ মন জন্মদিনের পোশাক-অধম
ওদের জাগতে দাও
সুরমা পরা চিকচিকে কালো চোখ
জটাধারী ভণ্ডধ্যানী
আর গেরুয়াধারী ভক্ষককুল
পার পাবে না আর

 

তোমাকে

 

পূর্বাহ্ণের পুরোটা সময় কেটেছে আমার শেকড়ের খোঁজে
নষ্ট সময়ের প্রতিকূলযাত্রী যুবকটি
এই মধ্যহ্নে কী চায়, তার চোখে চোখ রেখে
পড়ে দেখলে কী এমন ক্ষতি হত তোমার?
প্রচলিত ধারার বিপ্রতীপ চিন্তার সঙ্গে
তোমার সহাবস্থান কি কোনোদিনও হবে না
এমন-কী সমান্তরালও?
বিচ্ছিন্ন সুখ? আমার চেতনার ব্যবচ্ছেদেও
খুঁজে পাবে না তুমি
মাংসাশীদের কাছে নিজের কদর বাড়াতে চাও
তো ওই রঙিন অ্যাকুরিয়ামই হবে
তোমার সুখের(?) নীড়


পরিচিতি

 

মং হ্লা প্রু পিন্টুর জন্ম ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ বর্তমান কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মধুখালি রাখাইন পাড়ায়। তাঁর বাবার নাম স্বর্গীয় আ থোঁই হ্রী (মাস্টার), মায়ের নাম স্বর্গীয়া চিং ওয়ান প্রু। তিনি লেখালেখি শুরু করেন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়। প্রথম কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন (১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত), পরে (১৯৯৯) শিক্ষকতায় চলে আসেন। তিনি বর্তমানে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলা সদরে অবস্থিত রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন।

বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, না উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়?

ইংরেজিতে লেখা হয় ... Girls' High School
কিন্তু বাংলায় লিখতে গিয়ে
কেউ লেখে ... বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
আর কেউ লেখে ... উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
আপনার আশেপাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় (যেখানে কেবল বালিকারাই পড়ে) গুলোর সাইনবোর্ড-এর দিকে তাকালে এর সত্যতা মিলবে।

আমার মতে প্রথমটাই (... বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) সঠিক। যেহেতু ইংরেজি Primary School, High School এবং College এর বাংলারূপ যথাক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়। তাই Girls' High School এবং Girls' College এর বাংলারূপ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বালিকা মহাবিদ্যালয়ই হবে।

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা শিক্ষা অধিদফতর থেকে পরিপত্র জারি করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঠিকটাকে ব্যবহার করতে আদেশ / নির্দেশ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

আপনারা কী বলেন?

বুধবার, নভেম্বর ২৫, ২০০৯

'হ্যালো, স্যার আপনার মতামত প্রয়োজন'

হ্যালো, স্যার আপনার মতামত প্রয়োজন... ২০০৫ সালের আগস্ট মাসের এক মধ্যরাতে তৎকালীন সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার মো. সহিদুজ্জামানের মুঠোফোনে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এলাকার জনৈক সন্ত্রাসীকে ক্রস ফায়ারে দেওয়ার আগে উপরের সংলাপটি বলেন। সিবিএন র আজকের সংখ্যায় তাঁর অনিয়মিত কলাম নানা মুনির নানা মত র ১৮ পর্বে সাবেক সাংসদ এই তথ্যটি প্রকাশ করেন। বিস্তারিত পড়ুন নীচের লিংকে---
Click This Link

শুক্রবার, নভেম্বর ২০, ২০০৯

হাইকোর্টের রায় বহাল, ফাঁসি ১২ জনেরই

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ে মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দী পাঁচ আসামির আপীল নাকচ করে দিয়েছে আপীল বিভাগ। এর ফলে হাইকোর্টের দেয়া ১২ আসামির মৃতু্যদণ্ড বহাল রেখেছে আদালত। আপীল বিভাগ যে পাঁচ আসামির আবেদন নাকচ করেছে তারা হলো, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে বাঙালী জাতি পেল এই ঐতিহাসিক রায়ের ঘোষণা। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা। আপীল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষ আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনে ভর্তি। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। শুধু অপেক্ষার পালা। আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ১১টা থেকে সরে আস্তে আস্তে ১১টা ৪৫ মিনেটে এসেছে। তখনই বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে বিচারপতি মো. আব্দুল আজিজ, বিচারপতি বিজন কুমার দাস (বিকে দাস), বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) বিচারকক্ষে এসে নিজ নিজ আসনে বসেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের আপীল বিভাগের বেঞ্চ প্রধান মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম গুরুগম্ভীরভাবে রায় ঘোষণা শুরু করেন। উদ্বেগ ও নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম ঘোষণা করলেন পাঁচ আসামির আপীল না মঞ্জুর করা হলো। এর ফলে হাইকোর্টের দেয়া ১২ আসামির মৃতু্যদণ্ড বহাল থাকল। এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবসান হলো বাঙালী জাতির এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার। পেঁৗছল বাঙালী ইতিহাসের একটি যুগের দ্বারপ্রান্তে। মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি কারাগারে আটক রয়েছে। অন্যদিকে ৬ আসামি পলাতক রয়েছে। এরা হলো লে. কর্নেল (অব) খোন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব) এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব) এন এইচএমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। লে. কর্নেল (অব) আব্দুল আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুইয়েতে মারা যায়।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে বিচারপতিরা এজলাসে বসেন, বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম ১১টা ৪৬ মিনিটে রায় পড়া শুরু করে ১১টা ৫০ মিনিটে শেষ করেন। রায়ে বলা হয় "আমাদের অভিমত হলো হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি ছয় আসামির বিষয়ে নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি করে কোন ভুল করেননি। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগ মামলা দায়েরের বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যাখ্যা গ্রহণ করে আদালত কোন ভুল করেননি।" রায়ে আরও বলা হয় "আসামিরা ঘটনার সময় একটিভ সার্ভিসে ছিলেন না। তাই সেনা আইনে বিচার না করে সাধারণ আইনে বিচার করায় আইনী কোন ভুল ছিল না।" বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য ষড়যন্ত্র হয়েছিল বিদ্রোহের জন্য। রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এসব কারণে আসামিদের আপীল খারিজ করা হল।
আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় ঘোষণার পর সরকার পক্ষের প্রধান কেঁৗসুলি আনিসুল হক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, হাইকোর্টে পুরো রায় বহাল রয়েছে। পলাতক ৭ জনের কেউ ফিরে এলে বিলম্ব মার্জনার আবেদন করতে পারবে। পরে সরকার ও আসামি পক্ষ সাংবাদিকদের ব্রিফিং প্রদান করেন। সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। বিচারকক্ষে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সকাল ১০টার সময় ঢুকতে দেয়া হয়। রাজনীতিবিদদের মধ্যে এসেছিলেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ। আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান কেঁৗসুলি এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এএফএম মেজবাহউদ্দিন, আজমালুর হোসেন কিউসি, তৌফিক নেওয়াজ, শ ম রেজাউল করিম, জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী, রবিউল আলম বুদু, তাজউদ্দিন মেহেদী, নুরুল ইসলাম সুজন, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, মোশারফ হোসেন কাজল, তৌফিক করীম, ইমতিয়াজ উদ্দিন আসিফ, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, আব্দুল মতিন খসরু, বাদী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম ও আইও আব্দুল কাহার আকন্দ।
অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম জহিরুল হক, ডিএজি এএস মো. আব্দুল মোবিন, ডিএজি মো. মোতাহার হোসেন সাজু, এএজি মাহফুজা বেগম, এএজি মো. একরামুল হক, এএজি খোন্দকার দিলারুজ্জামান, এএজি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি, এএজি সর্দার মো. রাসেদ জাহাঙ্গীর ও এএজি এবিএম আলতাফ হোসেন। আসামি পক্ষে ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক খান ও ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বহু প্রতীক্ষিত এ রায় শোনার জন্য গোটা জাতি ছিল উন্মুখ। শত শত আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আদালত প্রাঙ্গণে আসেন। লাখ লাখ জনতা টেলিভিশন ও বেতারে সরাসরি সম্প্রচার শোনেন। সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণার পরই আদালত প্রাঙ্গণে মৃতু্যদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে স্লোগান দেয়া হয়। এরপর আইনজীবী সম্মেলনকক্ষে ব্রিফিং প্রদান করেন সরকার ও আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। নিম্নে তা তুলে ধরা হল:

এ্যাটর্নি জেনারেল
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, ১৯ নবেম্বর বাঙালী জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। এই ঐতিহাসিক দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় ঘোষণা হলো। এটি মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ রায় হিসেবে পরিচিত হবে। মামলায় আসামিদের সমস্ত স্বচ্ছতা দেয়া হয়েছে। মামলা যাতে না করা হয়, সে কারণে মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি বিল জারি করেছিল। জিয়াউর রহমান, এরশাদ সরকার ইনডেমনিটি বহাল রেখেছিলেন। '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না আসলে ঐ কালো অধ্যায় বাতিল হতো না। এই রায়ের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
মাহবুবে আলম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়েরের জন্য বাদী মহিতুল ইসলামকে তাঁর সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দকেও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই মামলা বিলম্বিত করার জন্য আসামি পক্ষ বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। প্রথমে তারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে আদালতকে চ্যালেঞ্জ করে। এতে তারা আদালতে হেরে যায়। আপীল বিভাগেও তারা হেরে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। মাহবুবে আলম আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সেশন আদালতে ১৫০ দিন, হাইকোর্টে ৬৩ দিন, তৃতীয় বেঞ্চে ২৫ দিন শুনানি হয়েছে। এতে ১২ জনের আদেশ বহাল থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ৪ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দেশে ছিল। একজনকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, শেখ নাসের, শেখ মনি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে হত্যা করেছে। তাদের ফিরে পাব না। এই রায়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।

আনিসুল হক
সরকারপক্ষের প্রধান কেঁৗশুলি আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আজকে আমরা শেষ দরজায় এসে বিচার পেয়েছি। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৫টি বিবেচ্য বিষয় শুনানি করেছিল, তার রায় দিয়েছেন। অন্যান্য সময় যে রায় দেয়া হয়, তার ব্যতিক্রম ছিল এটি। আগে শুধু অর্ডার প্রসেসিং হতো। আজকে রায়ের বেশ কিছু অংশ পড়ে শোনানো হয়েছে। আদালত আসামিদের বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছে। তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জাতি ৩৪ বছর অপেক্ষার পর বিচার পেয়েছে। এ রায়ের পর শুকরিয়া আদায় করছি। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের জন্য মাগফিরাত কামনা করছি। অনেক দিন পর জাতি ন্যায় বিচার পেয়েছে।

ফজলে নূর তাপস
বঙ্গবন্ধুর দৌহিদ্র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৪ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছিল স্বাধীনতা পাবার জন্য। আজকে লজ্জা লাগে ৩৪ বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পাওয়ার জন্য। আজ গর্ববোধ করি স্বাধীন দেশে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট মাইলফলক রায় দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে। হাইকোর্টে মামলা পরিচালনা করার জন্য সিরাজুল হককে স্মরণ করতেই হয়। তিনি বলেন, '৭৫ সালের ১৯ নবেম্বর মা-বাবা আমার জন্মদিন পালন করতে পারেনি। আজ আমার জন্মদিনে সুপ্রীমকোর্ট রায় দিয়ে সর্বোচ্চ উপহার দিয়েছে। মা-বাবার হত্যার বিচার পেয়েছি। এটি ঐতিহাসিক রায়।

আ. ফ. ম. মোহিতুল ইসলাম
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী আ. ফ. ম. মোহিতুল ইসলাম বলেছেন, আমরা প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। এই দিনটির জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি। আমার ছোট ভাই রাসেল বলেছিল ওরা আমাকে মারবে না তো; আমি বলেছিলাম, না ওরা তোমাকে মারবে না। আমার সেই আশ্বাস ভুল ছিল। খুনীরা শিশু রাসেলকেও রক্ষা করেনি। '৭৬ সালে লালবাগ থানায় এজাহার করতে গেলে থানার এসআই আমার গালে থাপ্পড় মেরে বলে, তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি। সময় আসাতে আমি '৯৬-তে মামলা করেছি। দীর্ঘদিন হলেও মামলার খুনীদের বিচার হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, ৩৪ বছর পর আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হলো। রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌশলি আনিসুল হক ১৫ আগস্টে বাবা-মা হারানো বঙ্গবন্ধুর নাতি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে হানা দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে রাসেলসহ ২৮ জন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করে। ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর বিচারিক আদালত ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃতু্যদণ্ড প্রদান করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল ও মৃতু্যদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি হয় হাইকোর্টে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দ্বিধাবিভক্ত রায় দেয়। পরে তৃতীয় বেঞ্চ ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল ১২ জনের মৃতু্যদণ্ড অনুমোদন করে রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক পাঁচ আসামি আপীল করে। আপীল বিভাগের শুনানি শেষে, বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করা হয়। ঐ রায়ে পাঁচ আসামির আপীল নাকচ করে দেয়া হয়। ফলে হাইকোর্টের দেয়া ১২ আসামির মৃতু্যদণ্ড এখন বহাল থাকল।

সেরনিয়াবাত শেখ মণিসহ ২৪ নিহতের মামলা চালু হচ্ছে

৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সেই রাতে আরও ২৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ৩টি হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধুর ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা ও মোহাম্মদপুরের কামানের গোলায় হত্যাকাণ্ড_এই ৩টি হত্যা মামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছে। জোট সরকারের সময়ে এই মামলাগুলোকে স্থগিত ও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ আদালতে বিচার অনুষ্ঠিত হলেও সেই রাতে এই ৩ হত্যা মামলায় ২৪ নিহত হওয়ার বিচার আজ অবধি হতে দেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের পিতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিকে '৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ভোরে হত্যা করা হয়েছে ধানমণ্ডির বাসভবনে। এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে থানায় মামলা হয়। মামলাটি তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডিকে। সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে এই মামলার তদন্তকারী অফিসার নিযুক্ত করা হয়। জোট সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও জোট সরকারের প্রত্যাহার করে নেয়া শেখ মনি হত্যা মামলাটি পূর্বাবস্থায়ই রয়ে গেছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
শেখ মনি হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলা মামলা সাজানো নাটকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তিনি সিআইডি থেকে ইতোমধ্যেই অবসর নিয়েছেন। তারপর থেকে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সর্বোচ্চ আদালতে রায় ঘোষণার পর শেখ মনি হত্যা মামলাটির খোঁজ করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর ভগি্নপতি সাবেক পানি, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ ৮ জন নিহত হন মিন্টু রোড্রে তার সরকারী বাসভবনে। সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পিতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে স্থগিত অবস্থায় আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত খুনীদের পক্ষে আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থাগিতাদেশ দিয়ে রাখা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে উচ্চ আদালতে এই স্থাগিতাদেশ হয়।

'৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে সাবেক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টু রোডের সরকারী বাসভবন আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার খুনীরাসহ উচ্ছৃক্মখল সেনাসদস্যরা। অস্ত্রের মুখে বাসার ভেতরে ঢুকে বাসার সবাইকে একত্রিত করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি চার বছরের শিশু বাবু সেরনিয়াবাত, চাচাত ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, বাসার গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা, কাজের ছেলে পোটকা, আবদুর রহিম খান ওরফে রিন্টু। শিশু বাবু হচ্ছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে।

'৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদাসহ অন্যদের আসামি করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত শেষে '৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৬ সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়। চার্জশীট দাখিলের পর মামলাটি বিচারের জন্য আদালতে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে উচ্চ আদালতে আবেদন জানানোর প্রেক্ষিতে মামলাটি বিচারের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।

'৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময়ে খুনীদের কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হলে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শের শাহসুরি রোডের ৮ ও ৯ নম্বর বাড়িতে গিয়ে পড়ে। গৃহিণী রোজিয়া বেগম, তার ছোট মেয়ে নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম-১, আনোয়ারা বেগম-২, ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ্, রফিকুল, সাবিয়া, সাহাবুদ্দিন, আমিনুদ্দিন, কাশেদা ও দুই বছরের শিশু আনোয়ারা মারা যায়। '৯৬ সালের ২৯ নবেম্বর রোজিয়ার স্বামী মোহাম্মদ আলী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালে সিআইডি এই হত্যা মামলাটি তদন্ত করে চার্জশীট দেয়। চার্জশীটে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়। তারপর থেকে এই মামলাটির ন্যায় বিচারের আলোর মুখ দেখতে দেয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শেখ মনি হত্যা মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছিল সিআইডিকে। সিআইডির তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে। মুন্সি আতিকুর রহমান সিআইডি থেকে অবসরে চলে গেছেন। জোট সরকারের আমলে শেখ মনি হত্যা মামলাটির তদন্ত স্থগিত করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালতে ঘোষিত হওয়ার পর এখন শেখ মনি হত্যা মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম নতুন করে শুরু করতে আর কোন বাধা নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে স্টে করে রাখা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি স্থগিত করে রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে খুনীদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখার পর এখন এই মামলাটির স্থগিতাদেশ ভেকেন্ট করার আবেদন করে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ করে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হওয়ার পর '৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই রাতে মোহাম্মদপুরে কামানের গোলায় হত্যাকাণ্ড, শেখ মনি হত্যাকাণ্ড ও আবদুর রব সেরনিয়াবাত_এই ৩ হত্যা মামলার পুনর্তদন্ত ও পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবন

৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এই স্বর্ণখচিত দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সায়রা বেগম দম্পতির ঘর আলো করে আসা তাদের তৃতীয় সন্তান 'খোকা' একদিন হয়ে উঠলেন বাঙালির জিয়নকাঠির নায়ক।
৭ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনার শুরু তার। দু'বছর পর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে মিশনারি স্কুলে; কিন্তু ১২ বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে পড়াশোনায় সাময়িক বিরতি ঘটে। চার বছর পর আবার স্কুলে ভর্তি। ১৮ বছর বয়সে চাচাতো বোন বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তার।
১৯৪০ সালে মুজিব যোগ দেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে। এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স (এখনকার এসএসসি) পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরের বছর মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের 'ষড়যন্ত্রের' প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। ধর্মঘট পালনকালে সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রেফতার হন মুজিব। ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
ফরিদপুরে কর্ডনপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় ১১ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ২১ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের দাবি আদায়ে ধর্মঘট ঘোষণা করলে মুজিব সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেন। কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ তাকে জরিমানা করে। এ নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন মুজিব। ১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। কারাবন্দি মুজিব এর যুগ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৪ অক্টোবর তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এবার প্রায় দু'বছর পাঁচ মাস জেলে আটক থাকেন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে বন্দি অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালনের জন্য সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান মুজিব। এ দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি জেলখানায় অনশন শুরু করেন তিনি।
২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক ও শফিউর শহীদ হন। মুজিব জেলখানায় এর প্রতিবাদে টানা ১৭ দিন অনশন করেন।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টিই পায় যুক্তফ্রন্ট। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করেন।
১৫ মে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে মুজিব করাচি থেকে ঢাকায় ফেরেন এবং গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পান।
১৯৫৫ সালের ৫ জুন মুজিব গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭ জুন পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করে।
দলকে সব ধর্মের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দ প্রত্যাহার করা হয়। মুজিব আবার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
পরের বছরের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর মুজিবকে গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে আইয়ুব শাহি। প্রায় ১৪ মাস পর মুক্তি দিয়ে আবার জেলগেটে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের এক সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও মুজিব সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালোভাবে তোলা হয়।
১ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারাবাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন।
১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে একবার-দু'বার নয়, মোট আটবার গ্রেফতার হন মুজিব।
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এ মামলার আসামিদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে গোটা পূর্ববাংলা।
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও মামলায় আটকদের মুক্তি দাবিতে আন্দোলন শুরু করে যা, গণআন্দোলনে পরিণত হয়।
১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআরের গুলি আর বহু হতাহতের মধ্যদিয়ে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আইয়ুব সরকার ১ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানায়।
২২ ফেব্রুয়ারি চাপের মুখে সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে মুজিবসহ আসামিদের মুক্তি দেয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেওয়া হয়। এ সময় তিনি ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানান।
২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি বৈঠক ত্যাগ করে ঢাকা চলে আসেন।
২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন।
১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আবার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টির মধ্যে ৩০৫টি আসন পায় দলটি।
১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন; কিন্তু ১ মার্চ তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারাবাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আওয়ামী লীগ ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল ডাকে। হরতালের পরদিন বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অনিবার্য হয়ে ওঠা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে ঘোষণা দেন_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর আলোচনা হয়।
২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। বলা হয়ে থাকে, এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আসলে দমন অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন। এতে তিনি বলেন, 'সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।' তিনি সবাইকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানান।
২৬ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
এরপর ২৭ মার্চ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণাপত্রটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার পাঠ করেন।
২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন এবং তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ হয়।
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশকে সহায়তাকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতিস্বীকার করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিলি্ল হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পেঁৗছলে তাকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭৩ সালে নতুন সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু এক বিতর্কিত উদ্যাগে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে এটি করতে হচ্ছে এবং এটি দেশের জন্য ভালো হবে।

ইনডেমনিটির আদ্যোপান্ত

৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তত্কালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন।
অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত্ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাত্ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রকারী হিসাবে আবিভূর্ত হন। সে সময় বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জনাব সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। এটি এখন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত আছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে, অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তত্সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ওই বছর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা জার্মানীতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।

১৫ আগস্টের আগে ও পরে যেসব খবর ছাপা হয়

৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। সকালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ওই খবর ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়। দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত হয় আট পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র। আর এই পত্রিকা পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগেই সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সংবাদপত্রের খবর ছিল অনেকটাই বাকশালকেন্দ্রিক। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। কিন্তু আগস্টে বাকশালের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র যে চলছিল তার প্রমাণ ১৫ আগস্ট।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর ৪ আগস্ট সংখ্যার শীর্ষ খবর ছিল ‘জেলা বাকশাল সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই দিন দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘জাতীয় দলের জেলা সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই খবরের উপশিরোনামে বলা হয়, প্রতিটি কমিটিতে একজন সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক নিয়োগ। ৫ আগস্ট বাকশালের জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের খবর ছাপা হয় দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায়। অবশ্য ওই দিন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের বরাত দিয়ে পত্রিকাটির শীর্ষ খবরে বলা হয় ‘আটটি দেশের সঙ্গে শুল্ক রহিতের চুক্তি হবে।’
বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর: ১৫ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর প্রকাশিত হয়। প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গ্রামপর্যায়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’। শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে এ কথা বলেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মন্ত্রীর বক্তব্য আলাদা শিরোনামে এক বা দুই কলামে প্রকাশ হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চাই পরিকল্পিত জনসংখ্যা’। শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রথম পরিকল্পনাকালে ৪১ লাখ নতুন চাকরি হবে’। শিক্ষামন্ত্রী মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করতে সততার সাথে কাজ করুন’। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ’। বাকশালের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি জেলা সম্পাদকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না’। এ ছাড়া প্রথম পৃষ্ঠায় আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল, বঙ্গবন্ধু কাল জেলা গভর্নর ও সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। অপর খবরটি ছিল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল।
দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর প্রকাশ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে তখন সরকার কর্মকাণ্ড ছিল মূলত বাকশালকেন্দ্রিক। ১৪ আগস্টের পত্রিকায়ও বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলীর ‘অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লব’ শীর্ষক বক্তব্য শীর্ষ খবর হিসেবে ছাপা হয়। এ ছাড়া জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ কয়েকজন বাকশাল নেতার বক্তব্য পৃথক শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। ১৩ আগস্টও দৈনিক বাংলার খবরে প্রাধান্য পায় বাকশালের খবর।
সেদিন সেজেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৫ আগস্ট, রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। ওই দিন দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় বাম পাশে দুই কলামে প্রধান খবরে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ এ খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সাড়া’। পত্রিকার শেষ পাতায় বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে বক্স ফিচার ছিল ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে’। ওই দিন সকালে পাঠক পত্রিকায় এ খবর পেলেও তার আগেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অবশ্য ওই দিন কোনো সংবাদমাধ্যম সে খবর প্রকাশ করতে পারেনি।
দৈনিক বাংলায় যা ছাপা হয়েছিল: বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরদিন ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘খন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। ওই খবরের উপশিরোনামে ছোট্ট করে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ’।
খবরের প্রথম অনুচ্ছেদ ছিল—‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে নিহত হন বলে বলে ঘোষণা করা হয়।’
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস-এর বরাত দিয়ে একই খবরে বলা হয়, সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন ঘোষণা ও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। দুপুরের পর অবশ্য মুসল্লিদের জুমার নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে দেড় ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়।
ওই খবরে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের কাছ থেকে খন্দকার মোশতাকের শপথ নেওয়ার তথ্য, মোহাম্মদ উল্লাহকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ, ১০ মন্ত্রী ও ছয় প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। আরও উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার পৃথক পৃথক বেতার ভাষণে মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নয়া সরকারের প্রতি আনুগত্য ও দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সাবিউদ্দিন আহমেদ এবং আইজিপি এ এইচ নুরুল ইসলাম বেতার মারফত মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন মর্মে খবর প্রকাশ করা হয়।
ওই সংখ্যায় শীর্ষ খবরের বাঁ পাশে ছিল অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে মোশতাকের শপথ নেওয়ার ছবি। এর নিচে ছিল ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’ মর্মে মোশতাকের বেতার ভাষণ। ওই ভাষণের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণমায় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয়চিত্তে এগিয়ে এসেছেন।’
দৈনিক ইত্তেফাকে যা ছাপা হয়েছিল: ১৬ আগস্ট ইত্তেফাকে মূল শিরোনাম ছিল ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’। খবরের কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। শীর্ষ খবরের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’
ওই দিন ইত্তেফাকের বিশেষ সম্পাদকীয় ছিল ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’। এর শুরুতে বলা হয়, দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিবর্তনের এক বিষাদময় গুরুত্ব রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরেরও ঊর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তবক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় গভীর হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ...গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে।’ সম্পাদকীয়তে এসব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সামরিক হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে ওঠার কথা উল্লেখ করা হয়।
১৬ আগস্টের ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবার ও নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল মোশতাক সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি, নয়া সরকারের জন্য জুমার নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ, বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার আশ্বাস, গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারণ করে বি এ সিদ্দিকীকে রেডক্রসের চেয়ারম্যান নিয়োগ, লন্ডন হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ ও সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলাসহ কয়েকটি খবর।
ওসমানি, জিয়া, এরশাদ ও ভাসানী: ২৪ আগস্ট মোশতাক সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল এম এ জি ওসমানি। দৈনিক বাংলায় এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ওসমানী জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। একদলীয় শাসন পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। ওই দিনের পত্রিকায় মওলানা হামিদ খান ভাসানী বিবৃতিতে বলেন, মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক মুজিব সরকারের সহায়তায় বিদেশি শোষকদের সঙ্গে আঁতাত করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে। তিনি দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাদের কঠোর সাজা দেওয়ার দাবি জানান।
এদিকে ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং দৈনিক বাংলায় এটা ছিল মূল খবর। এতে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে রদবদলের খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে কে এম সফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত করে মেজর জিয়ার স্থলে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগিরকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে বিডিআরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অন্যান্য খবর: ১৫ আগস্টের পর সংবাদমাধ্যমে মোশতাক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। এ ছাড়া উন্নয়ন ও আশাব্যঞ্জক খবর প্রকাশিত হয়। ২০ আগস্ট দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘নয়া সরকারের সাথে বাদশাহ খালেদের ইসলামী সংহতি প্রকাশ, সৌদী আরব ও সুদানের স্বীকৃতি’। ওই দিন প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ খন্দকার মোশতাকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছাপা হয়। আরেক খবরে বলা হয়, ‘দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক’।
২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী কোরবান আলী ও আব্দুস সামাদ আজাদসহ ২৬ শীর্ষ মন্ত্রী, সাংসদ ও বাকশাল নেতাকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের পত্রিকায় ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বড় করে ছাপা হয়।
২২ আগস্ট মোশতাক সরকার দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ তাদের আগের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের এই ঘোষণা ২৩ আগস্ট দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়।

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৯, ২০০৯

১৯৭৫ থেকে ২০০৯

৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ পর্যন্ত এই হত্যা মামলার কালপঞ্জি তুলে ধরা হল:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে শেষ রাতে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এই অভ্যুত্থান স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামী লীগ সরকারকেও উৎখাত করে।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর- স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোস্তাক আহমদ বিচারের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষা করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তী বিএনপি সরকার ১৯৭৭ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসাবে অনুমোদন করে।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।
১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর- রাষ্ট্রপতির আবাসিক একান্ত সহকারি (পিএ) এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।
১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা এ মামলার তদন্ত শুরু করে।
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর- খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমিনিটি আইন বাতিল।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি- সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।
১৯৯৭ সালের ১ মার্চ- ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর বিচার কার্যের জন্য মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান।
১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ- ছয় আসামীর উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ২০ মার্চ- সরকার ১৪ জন পলাতক আসামীর পক্ষে মামলা পরিচালনায় ১৪ জন আইনজীবী নিয়োগ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করায় ওই ১৪ আসামী বিদেশে পালিয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৬ এপ্রিল- বিচারিক আদালতে অভিযোগের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৭ সালের ৭ এপ্রিল- অভিযুক্তদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়।
১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামী কর্নেল রশিদের স্ত্রী জোবাইদা রশিদের আইনজীবী হাইকোর্টে বিচারিক আদালতের বিরুদ্ধে অনাস্থা পেশ করলে শুনানির প্রথম দিনেই আকস্মিকভাবে বিচারকার্য মুলতবি হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ২৯ এপ্রিল- আসামী পক্ষের আপিল হাইকোর্টে খারিজ হওয়ার পর পুনরায় মামলার কার্যক্রম শুরু।
১৯৯৭ সালের ২৯ এপ্রিল- এই মামলার অপর এক আসামীর কৌসুলি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে অস্থায়ী বিচারিক আদালত গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করায় মামলাটি পুনরায় শুরু হওয়ার পরপরই আবারও স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল- হাইকোর্ট অস্থায়ী বিচারিক আদালত গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা আবেদনটি নাকচ করেন।
১৯৯৭ সালের ৪ মে- এই মামলার আসামী জোবাইদা রশিদের আইনজীবী মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময়ের আবেদন করলে হাই কোর্ট এক মাসের জন্য বিচারকার্য স্থগিত ঘোষণা করে।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন- মামলাটি পুনরায় শুরু হওয়ার পরপরই আসামী জোবাইদার আইনজীবী মামলায় তার মক্কেলকে জড়িত করার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে তৃতীয়বারের মতো এর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই- ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে মামলাটি পুনরায় শুরু হয়। জোবাইদাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই- প্রধান স্বাক্ষী মোহিতুল ইসলাম আদালতে স্বাক্ষ্য প্রদান করেন।
১৯৯৮ সালের ২ মার্চ- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ইনডেমনিটি আইন বাতিলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি আপিল সুদীর্ঘ ১৫ দিনের শুনানির পর খারিজ করেন। এর ফলে খুনিদের বিচার করার ক্ষেত্রে সকল বাধা অপসারিত হয়।
১৯৯৮ সালের ৯ জুলাই- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামী মেজর বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ থাইল্যান্ডের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যে দু’জন আসামীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উপর গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে মেজর বজলুল হুদা তাদের অন্যতম।
১৯৯৮ সালের ২১ জুলাই- তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কাহার আকন্দের স্বাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যদিয়ে আদালতে ৭৪ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ৬১ জনকে জেরা সম্পন্ন হয়।
১৯৯৮ সালের ৫ আগস্ট- স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে অভিযুক্তরা নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেন।
১৯৯৮ সালের ১২ আগস্ট- প্রধান সরকারি কৌসুলি সিরাজুল হকের বক্তব্যের পর রাষ্ট্র ও আসামী পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
২০০০ সালের ২৪ আগস্ট- হাইকোর্টে একই সঙ্গে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়।
১৯৯৮ সালের ১৩ অক্টোবর- দু’পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে ১৪৬ তম কার্যদিবসে ১৭ মাসের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর- মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর- বরখাস্তকৃত মেজর বজলুল হুদাকে বিমান বাহিনীর একটি বিমানযোগে থাইল্যাণ্ডের কারাগার থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর- হাই কোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামীর মাঝে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এবিএম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করেন।
২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি- বিভক্ত রায় প্রদানের ফলে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি দ্বিতীয় বেঞ্চের তৃতীয় বিচারকের কাছে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় এর শুনানি আরেকটি উচ্চ আদালতে শুরু হয়।
২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল- তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন।
২০০৭ সালের ১৮ জুন- যুক্তরাষ্ট্র সাবেক লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিনকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়।
২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট- রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন।
২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট- আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামীকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট- আপিল বিভাগ ৫ অক্টোবর আপিল শুনানি শুরুর তারিখ নির্ধারণ করেন।
২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর- মামলার চূড়ান্ত শুনানি আপিল বিভাগে শুরু হয়।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর- বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামীর দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ।

রবিবার, নভেম্বর ০৮, ২০০৯

বদলে দেওয়ার প্রস্তাব

মরাতো 'প্রথম আলো'র উদ্যোগে শপথ নিয়েছিলাম যে, নিজে বদলে যাব এবং অপরকে বদলে দেব। আর 'বদলে যাও, বদলে দাও' --এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করে আমি একটা প্রস্তাব উত্থাপন করছি। প্রস্তাবটা এই, আমাদের সম্মানিত ডাক্তাররা রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন ওষুধের নাম লিখে। ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নামের পরিবর্তে ওষুধের generic নাম লেখা যায় না? যেমন: ওষুধের নাম Napa, Parapyral, Acee, Pyralgin, Aceta ইত্যাদির পরিবর্তে generic নাম Paracetamol BP 500mg লেখা যায় না?
জানি, এটা করতে গেলে ওষুধ কোম্পানি, ডাক্তার, ওষুধ ব্যবসায়ী প্রভৃতি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে বাধা আসবে। রোগী তথা জনসাধারণের স্বার্থে ওষুধ প্রশাসন তথা সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করলে আপামর জনগণ এর পক্ষে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আর এটা করা গেলে বদলে দেওয়ার একটা উৎকৃষ্ট নজির স্থাপিত হবে।