বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০১৩

বিশ্বাসে চির এবং ভাঙা মনের সাম্প্রতিক ভাবনা

[লেখাটি তৈরি করা হয়েছে 'রামু: সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংকলন'-এর জন্য। সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল গত বই মেলায়। এ জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ডেডলাইনের আগেই লেখাটি তৈরি করে সম্পাদক বরাবর পৌঁছাতে হয়েছে, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সময়ের অভাবে অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় লেখাটিতে আনা যায়নি। বিলম্বে হলেও সংকলনটি চলতি মাসের শেষে বাজারে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সম্পাদক নিশ্চিত করেছেন। --- মং হ্লা প্রু পিন্টু]

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত জেলা কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এর দীর্ঘতম (বিশ্বের) সমুদ্র সৈকত। আর কক্সবাজারের অন্যতম উপজেলা রামুর প্রধান পর্যটন স্পট হচ্ছে বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শনসমূহ। রামুর লামার পাড়া রাখাইন বৌদ্ধ বিহারকে তো বিশ্ব-ঐতিহ্যেরই (উত্তরাধিকার) অংশ মনে করা হয়ে থাকে, যদিও স্বীকৃত নয়। রামুর মতো বার্মাটিক কাঠের তৈরি কারুকার্যময় দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার দেশের অন্য কোথাও নেই। তাই এগুলোর আর্থিক মূল্যের চেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যই বেশি।

রামুর একটা সুনাম রয়েছে অসাম্প্রদায়িক লোকালয় হিসাবে। ব্যবসা ও চাকরিসূত্রে যাঁরা ইতিপূর্বে রামুতে থেকেছেন এবং বর্তমানে থাকছেন তাঁরা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন। তা হল এই, রামুর মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লোকালয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা দেশের অন্য কোথাও নেই। এখানে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন। আর সে কারণেই ব্যবসা ও চাকরিসূত্রে আসা অন্যান্য এলাকার মানুষজনও পরবর্তীতে এখানে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছেন। সেই রামুতে কিনা গত ২৯ সেপ্টেম্বর (২০১২) রাতে সাম্প্রদায়িক হামলা (জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুর) হয়ে গেল! তাও আবার ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে, বেছে-বেছে কেবল বৌদ্ধদের।

রামুর এই ঘটনাকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমার তেমন চোখে পড়েনি। বেশির ভাগই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, নয় তো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। এমন-কী পত্রিকার প্রতিবেদনগুলোও সে দোষে দুষ্ট। তবে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ করেছে জাতীয় দৈনিক সমকাল, Daily Star ও New Age. যাঁরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, এটা যে পূর্বপরিকল্পিত এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পূর্বপরিকল্পিত না হলে একটা ঠুনকো কারণ (অজুহাত) দেখিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে হাজার-হাজার লোক জড়ো করে উত্তেজনা ছড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কোনো অবস্থাতেই সম্ভব না।

ইতিমধ্যে এও জানা হয়ে গেছে যে, গত জুনে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে যে জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে রামুর ঘটনা তারই বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল মহলের প্রতিশোধমূলক হামলা। তখন (জুনে) দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার নিমিত্তে সরকারের কঠোর মনোভাব ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে দেশীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো শতচেষ্টা করেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। তাই পরে ঠাণ্ডামাথায় একটা অজুহাত দেখিয়ে বিলম্বে হলেও তাদের হীন উদ্দেশ্য ঠিকই হাসিল করে নিয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা এবং প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কর্তাব্যক্তিদের মৌন সমর্থনের কারণে।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে। সেই সময়ও এর বদলা নেওয়ার জন্য রামু ফকিরা বাজারের কাপড়পট্টি এলাকায় (ছবি ট্যাগ সংক্রান্ত বর্তমান ঘটনাটাও ঘটেছে একই এলাকায় অবস্থিত কম্পিউটার দোকানে) মাইকে ঘোষণা করা হয়েছিল বলে বয়োবৃদ্ধরা এখনও বলাবলি করেন। কিন্তু তখনকার মানুষজন তত সাম্প্রদায়িক ছিলেন না বলে কোনো অঘটন ঘটেনি।

যে রামুবাসী নিজেরা অসাম্প্রদায়িক বলে এতদিন বড়াই করতেন, তাঁদেরও তো তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি এই সাম্প্রদায়িক ধ্বংসলীলা চলাকালে কিংবা অব্যবহিত পরে। যাঁরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বুকে লালন করেন ও এর বিকাশ ঘটাতে চান তাঁদের তো এ রকম নীরব দর্শক হয়ে থাকার কথা না। তা হলে কি রামুর বর্তমান অধিবাসীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী নন?

মানুষের মৌলিক চাহিদা বর্তমানে পাঁচটি হলেও আগে বলা হত তিনটি (অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান)। শিক্ষা ও চিকিৎসাকে তখনও মৌলিক চাহিদা বলে বিবেচনায় আনা হয়নি। সেই সময় রামুর এক দানশীল ব্যক্তি, জাতিতে রাখাইন বৌদ্ধ, দানবীর খিজারী রামু তথা কক্সবাজার এলাকার মানুষের শিক্ষা ও চিকিৎসার কথা ভাবতে পেরেছিলেন, ভেবেছিলেন। এবং ভেবেছিলেন বলেই তিনি এলাকায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনসহ পানীয় জলের জন্য দিঘি খনন করার মতো জনহিতকর কর্মগুলো করে গেছেন। এই বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রাতঃস্মরণীয় দানবীরের অবদান কি রামুবাসী ভুলে যেতে বসেছেন? তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় যে রামু ও আশেপাশের হাজার-হাজার মানুষকে আলোকিত করেছে তা কি রামুর বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা?

রামুর বেশির ভাগ বৌদ্ধ নিদর্শন (যেমন: লামার পাড়া রাখাইন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনাস্থ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত উ চা ত ফা জাদি এবং শ্রীকুলস্থ রাখাইন বড় বৌদ্ধ বিহার) দানবীর খিজারী কিংবা তাঁর নিকট-আত্মীয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। আর এসব বৌদ্ধ উপাসনালয় কিনা পুড়িয়ে দিয়েছে, নয় তো ভাঙচুর করেছে রামুরই অকৃতজ্ঞ লোকজন! অন্তত রাখাইনদের সামৌ ছিং (শাদা ছিং নামে সমধিক পরিচিত) ভাঙচুরের যেসব ছবি আমরা ফেসবুকে দেখেছি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় সেসব ছবির যে পরিচিতি ছাপা হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, হামলাকারীরা রামু সদরেরই বাসিন্দা। তা হলে কি আমরা বুঝে নেব, রাখাইন দানবীর খিজারী প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠটি এলাকার মানুষের মন থেকে অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয়নি? তাঁরা আলোকিত মানুষের মুখোশধারী মাত্র?

[লেখক পরিচিতি: মং হ্লা প্রু পিন্টু; শিক্ষক, লেখক ও সমাজকর্মী]

কোন মন্তব্য নেই: