শুক্রবার, নভেম্বর ২০, ২০০৯

১৫ আগস্টের আগে ও পরে যেসব খবর ছাপা হয়

৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। সকালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ওই খবর ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়। দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত হয় আট পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র। আর এই পত্রিকা পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগেই সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সংবাদপত্রের খবর ছিল অনেকটাই বাকশালকেন্দ্রিক। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। কিন্তু আগস্টে বাকশালের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র যে চলছিল তার প্রমাণ ১৫ আগস্ট।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর ৪ আগস্ট সংখ্যার শীর্ষ খবর ছিল ‘জেলা বাকশাল সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই দিন দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘জাতীয় দলের জেলা সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই খবরের উপশিরোনামে বলা হয়, প্রতিটি কমিটিতে একজন সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক নিয়োগ। ৫ আগস্ট বাকশালের জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের খবর ছাপা হয় দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায়। অবশ্য ওই দিন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের বরাত দিয়ে পত্রিকাটির শীর্ষ খবরে বলা হয় ‘আটটি দেশের সঙ্গে শুল্ক রহিতের চুক্তি হবে।’
বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর: ১৫ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর প্রকাশিত হয়। প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গ্রামপর্যায়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’। শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে এ কথা বলেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মন্ত্রীর বক্তব্য আলাদা শিরোনামে এক বা দুই কলামে প্রকাশ হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চাই পরিকল্পিত জনসংখ্যা’। শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রথম পরিকল্পনাকালে ৪১ লাখ নতুন চাকরি হবে’। শিক্ষামন্ত্রী মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করতে সততার সাথে কাজ করুন’। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ’। বাকশালের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি জেলা সম্পাদকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না’। এ ছাড়া প্রথম পৃষ্ঠায় আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল, বঙ্গবন্ধু কাল জেলা গভর্নর ও সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। অপর খবরটি ছিল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল।
দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর প্রকাশ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে তখন সরকার কর্মকাণ্ড ছিল মূলত বাকশালকেন্দ্রিক। ১৪ আগস্টের পত্রিকায়ও বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলীর ‘অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লব’ শীর্ষক বক্তব্য শীর্ষ খবর হিসেবে ছাপা হয়। এ ছাড়া জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ কয়েকজন বাকশাল নেতার বক্তব্য পৃথক শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। ১৩ আগস্টও দৈনিক বাংলার খবরে প্রাধান্য পায় বাকশালের খবর।
সেদিন সেজেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৫ আগস্ট, রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। ওই দিন দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় বাম পাশে দুই কলামে প্রধান খবরে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ এ খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সাড়া’। পত্রিকার শেষ পাতায় বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে বক্স ফিচার ছিল ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে’। ওই দিন সকালে পাঠক পত্রিকায় এ খবর পেলেও তার আগেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অবশ্য ওই দিন কোনো সংবাদমাধ্যম সে খবর প্রকাশ করতে পারেনি।
দৈনিক বাংলায় যা ছাপা হয়েছিল: বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরদিন ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘খন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। ওই খবরের উপশিরোনামে ছোট্ট করে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ’।
খবরের প্রথম অনুচ্ছেদ ছিল—‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে নিহত হন বলে বলে ঘোষণা করা হয়।’
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস-এর বরাত দিয়ে একই খবরে বলা হয়, সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন ঘোষণা ও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। দুপুরের পর অবশ্য মুসল্লিদের জুমার নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে দেড় ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়।
ওই খবরে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের কাছ থেকে খন্দকার মোশতাকের শপথ নেওয়ার তথ্য, মোহাম্মদ উল্লাহকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ, ১০ মন্ত্রী ও ছয় প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। আরও উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার পৃথক পৃথক বেতার ভাষণে মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নয়া সরকারের প্রতি আনুগত্য ও দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সাবিউদ্দিন আহমেদ এবং আইজিপি এ এইচ নুরুল ইসলাম বেতার মারফত মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন মর্মে খবর প্রকাশ করা হয়।
ওই সংখ্যায় শীর্ষ খবরের বাঁ পাশে ছিল অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে মোশতাকের শপথ নেওয়ার ছবি। এর নিচে ছিল ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’ মর্মে মোশতাকের বেতার ভাষণ। ওই ভাষণের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণমায় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয়চিত্তে এগিয়ে এসেছেন।’
দৈনিক ইত্তেফাকে যা ছাপা হয়েছিল: ১৬ আগস্ট ইত্তেফাকে মূল শিরোনাম ছিল ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’। খবরের কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। শীর্ষ খবরের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’
ওই দিন ইত্তেফাকের বিশেষ সম্পাদকীয় ছিল ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’। এর শুরুতে বলা হয়, দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিবর্তনের এক বিষাদময় গুরুত্ব রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরেরও ঊর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তবক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় গভীর হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ...গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে।’ সম্পাদকীয়তে এসব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সামরিক হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে ওঠার কথা উল্লেখ করা হয়।
১৬ আগস্টের ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবার ও নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল মোশতাক সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি, নয়া সরকারের জন্য জুমার নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ, বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার আশ্বাস, গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারণ করে বি এ সিদ্দিকীকে রেডক্রসের চেয়ারম্যান নিয়োগ, লন্ডন হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ ও সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলাসহ কয়েকটি খবর।
ওসমানি, জিয়া, এরশাদ ও ভাসানী: ২৪ আগস্ট মোশতাক সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল এম এ জি ওসমানি। দৈনিক বাংলায় এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ওসমানী জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। একদলীয় শাসন পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। ওই দিনের পত্রিকায় মওলানা হামিদ খান ভাসানী বিবৃতিতে বলেন, মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক মুজিব সরকারের সহায়তায় বিদেশি শোষকদের সঙ্গে আঁতাত করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে। তিনি দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাদের কঠোর সাজা দেওয়ার দাবি জানান।
এদিকে ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং দৈনিক বাংলায় এটা ছিল মূল খবর। এতে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে রদবদলের খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে কে এম সফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত করে মেজর জিয়ার স্থলে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগিরকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে বিডিআরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অন্যান্য খবর: ১৫ আগস্টের পর সংবাদমাধ্যমে মোশতাক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। এ ছাড়া উন্নয়ন ও আশাব্যঞ্জক খবর প্রকাশিত হয়। ২০ আগস্ট দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘নয়া সরকারের সাথে বাদশাহ খালেদের ইসলামী সংহতি প্রকাশ, সৌদী আরব ও সুদানের স্বীকৃতি’। ওই দিন প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ খন্দকার মোশতাকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছাপা হয়। আরেক খবরে বলা হয়, ‘দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক’।
২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী কোরবান আলী ও আব্দুস সামাদ আজাদসহ ২৬ শীর্ষ মন্ত্রী, সাংসদ ও বাকশাল নেতাকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের পত্রিকায় ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বড় করে ছাপা হয়।
২২ আগস্ট মোশতাক সরকার দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ তাদের আগের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের এই ঘোষণা ২৩ আগস্ট দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়।

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৯, ২০০৯

১৯৭৫ থেকে ২০০৯

৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ পর্যন্ত এই হত্যা মামলার কালপঞ্জি তুলে ধরা হল:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে শেষ রাতে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এই অভ্যুত্থান স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামী লীগ সরকারকেও উৎখাত করে।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর- স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোস্তাক আহমদ বিচারের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষা করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তী বিএনপি সরকার ১৯৭৭ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসাবে অনুমোদন করে।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।
১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর- রাষ্ট্রপতির আবাসিক একান্ত সহকারি (পিএ) এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।
১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা এ মামলার তদন্ত শুরু করে।
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর- খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমিনিটি আইন বাতিল।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি- সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।
১৯৯৭ সালের ১ মার্চ- ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর বিচার কার্যের জন্য মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান।
১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ- ছয় আসামীর উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ২০ মার্চ- সরকার ১৪ জন পলাতক আসামীর পক্ষে মামলা পরিচালনায় ১৪ জন আইনজীবী নিয়োগ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করায় ওই ১৪ আসামী বিদেশে পালিয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৬ এপ্রিল- বিচারিক আদালতে অভিযোগের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৭ সালের ৭ এপ্রিল- অভিযুক্তদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়।
১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামী কর্নেল রশিদের স্ত্রী জোবাইদা রশিদের আইনজীবী হাইকোর্টে বিচারিক আদালতের বিরুদ্ধে অনাস্থা পেশ করলে শুনানির প্রথম দিনেই আকস্মিকভাবে বিচারকার্য মুলতবি হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ২৯ এপ্রিল- আসামী পক্ষের আপিল হাইকোর্টে খারিজ হওয়ার পর পুনরায় মামলার কার্যক্রম শুরু।
১৯৯৭ সালের ২৯ এপ্রিল- এই মামলার অপর এক আসামীর কৌসুলি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে অস্থায়ী বিচারিক আদালত গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করায় মামলাটি পুনরায় শুরু হওয়ার পরপরই আবারও স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল- হাইকোর্ট অস্থায়ী বিচারিক আদালত গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা আবেদনটি নাকচ করেন।
১৯৯৭ সালের ৪ মে- এই মামলার আসামী জোবাইদা রশিদের আইনজীবী মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময়ের আবেদন করলে হাই কোর্ট এক মাসের জন্য বিচারকার্য স্থগিত ঘোষণা করে।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন- মামলাটি পুনরায় শুরু হওয়ার পরপরই আসামী জোবাইদার আইনজীবী মামলায় তার মক্কেলকে জড়িত করার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে তৃতীয়বারের মতো এর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই- ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে মামলাটি পুনরায় শুরু হয়। জোবাইদাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই- প্রধান স্বাক্ষী মোহিতুল ইসলাম আদালতে স্বাক্ষ্য প্রদান করেন।
১৯৯৮ সালের ২ মার্চ- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ইনডেমনিটি আইন বাতিলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি আপিল সুদীর্ঘ ১৫ দিনের শুনানির পর খারিজ করেন। এর ফলে খুনিদের বিচার করার ক্ষেত্রে সকল বাধা অপসারিত হয়।
১৯৯৮ সালের ৯ জুলাই- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামী মেজর বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ থাইল্যান্ডের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যে দু’জন আসামীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উপর গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে মেজর বজলুল হুদা তাদের অন্যতম।
১৯৯৮ সালের ২১ জুলাই- তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কাহার আকন্দের স্বাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যদিয়ে আদালতে ৭৪ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ৬১ জনকে জেরা সম্পন্ন হয়।
১৯৯৮ সালের ৫ আগস্ট- স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে অভিযুক্তরা নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেন।
১৯৯৮ সালের ১২ আগস্ট- প্রধান সরকারি কৌসুলি সিরাজুল হকের বক্তব্যের পর রাষ্ট্র ও আসামী পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
২০০০ সালের ২৪ আগস্ট- হাইকোর্টে একই সঙ্গে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়।
১৯৯৮ সালের ১৩ অক্টোবর- দু’পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে ১৪৬ তম কার্যদিবসে ১৭ মাসের বিচার কার্যক্রম শেষ হয়।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর- মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর- বরখাস্তকৃত মেজর বজলুল হুদাকে বিমান বাহিনীর একটি বিমানযোগে থাইল্যাণ্ডের কারাগার থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর- হাই কোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামীর মাঝে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এবিএম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করেন।
২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি- বিভক্ত রায় প্রদানের ফলে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি দ্বিতীয় বেঞ্চের তৃতীয় বিচারকের কাছে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় এর শুনানি আরেকটি উচ্চ আদালতে শুরু হয়।
২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল- তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন।
২০০৭ সালের ১৮ জুন- যুক্তরাষ্ট্র সাবেক লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিনকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়।
২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট- রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন।
২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট- আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামীকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট- আপিল বিভাগ ৫ অক্টোবর আপিল শুনানি শুরুর তারিখ নির্ধারণ করেন।
২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর- মামলার চূড়ান্ত শুনানি আপিল বিভাগে শুরু হয়।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর- বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামীর দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ।

রবিবার, নভেম্বর ০৮, ২০০৯

বদলে দেওয়ার প্রস্তাব

মরাতো 'প্রথম আলো'র উদ্যোগে শপথ নিয়েছিলাম যে, নিজে বদলে যাব এবং অপরকে বদলে দেব। আর 'বদলে যাও, বদলে দাও' --এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করে আমি একটা প্রস্তাব উত্থাপন করছি। প্রস্তাবটা এই, আমাদের সম্মানিত ডাক্তাররা রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন ওষুধের নাম লিখে। ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নামের পরিবর্তে ওষুধের generic নাম লেখা যায় না? যেমন: ওষুধের নাম Napa, Parapyral, Acee, Pyralgin, Aceta ইত্যাদির পরিবর্তে generic নাম Paracetamol BP 500mg লেখা যায় না?
জানি, এটা করতে গেলে ওষুধ কোম্পানি, ডাক্তার, ওষুধ ব্যবসায়ী প্রভৃতি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে বাধা আসবে। রোগী তথা জনসাধারণের স্বার্থে ওষুধ প্রশাসন তথা সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করলে আপামর জনগণ এর পক্ষে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আর এটা করা গেলে বদলে দেওয়ার একটা উৎকৃষ্ট নজির স্থাপিত হবে।