সোমবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯

'পেংওয়া' থেকে কক্সবাজার

বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একটি হচ্ছে সীমান্ত জেলা কক্সবাজার। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ২০.৩৫ ডিগ্রি থেকে ২১.৫৬ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা এবং ৯১.৫০ ডিগ্রি থেকে ৯২.২৩ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখার মধ্যে এর অবস্থান। এর উত্তরে চট্টগ্রাম, পূর্বে পার্বত্য বান্দরবান জেলা ও মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ-পূর্বে আন্তর্জাতিক রেখা বরাবর 'নেহ ম্রাই' অর্থাৎ নাফ নদী অবস্থিত। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেলার আয়তন ২ হাজার ২৬০ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১০ লাখ ২৬ হাজার ১৭২ জন। রামু, চকরিয়া, মহেশখালি, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুবদিয়া ও সদরসহ ৭টি থানা নিয়ে গঠিত এই জেলার নামকরণ হয়েছে মূলত কক্সবাজার সদরের নাম থেকেই। 'কক্সবাজার' নামটি ইতিহাসের বিবেচনায় খুব প্রাচীন নয়, মাত্র ২০০ বছরের পুরোনো। কিন্তু এলাকার ভূভাগটি যেমন প্রাচীন তেমনি এই ভূভাগের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। কক্সবাজারের বর্তমান নামের মধ্যে স্মৃতি হিসাবে অম্লান ও অক্ষয় রয়েছে সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পারের এক সৈনিক 'ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স'-এর নাম।
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো কক্সবাজারের নামকরণকে ঘিরেও প্রচলিত রয়েছে হরেক কিংবদন্তি। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ ঐতিহাসিক 'জোঁ অ্যা দ্য বেরোস' তাঁর মানচিত্রে এবং ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি নাবিক 'ছিদি আলি ছিদিবি' তাঁর বর্ণনায় এই অঞ্চলের নাম বাকোলিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস গবেষকদের মতে কক্সবাজারের প্রাচীন নাম 'পেংওয়া'। এটি একটি রাখাইন শব্দ যার অর্থ হলদে ফুল। কক্সবাজার সদরের পার্শ্ববর্তী থানা রামু অঞ্চলটি রাখাইনদের কাছে আজও 'পেংওয়া' বা 'পাংওয়া' নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি পর্যন্ত কক্সবাজার শহরাঞ্চলসহ বর্তমান রামু অঞ্চলটির পরিচিতি ছিল 'পেংওয়া' নামে।
১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা শ্রী সুধম্মার মৃত্যুতে সমগ্র আরাকানে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য প্রকটভাবে দেখা দেয়। সেই সময় শ্রী সুধম্মার পুত্র 'ঙা থোয়েং খাইং' আরাকান থেকে পালিয়ে এসে বাকোলিয়া (এর বর্তমান নাম বাঁকখালি) নদীর তীরে এক ছোট পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পরবর্তীকালে তাঁর সহযোগী আরাকানের সাবেক মন্ত্রী 'ঙা লাহ রুন' বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে 'উ অগ্গমেধাবী' নাম ধারণ করে পাহাড়ের পাদদেশে নতুন বসতি স্থাপন করেন এবং এর নাম রাখেন 'অং খ্যেং থা'। নতুন বসতি স্থাপনের ফলে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে তৎকালীন 'পেংওয়া'র একাংশ নতুন বসতির নামে অর্থাৎ 'অং খ্যেং থা' হিসাবে পরিচিতি লাভ করে বলে অনেকে মনে করেন। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে 'রাখাইন-প্রে' তথা আরাকানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি দেশবাসীর আস্থাহীনতার সুযোগে তৎকালীন বার্মার সাম্রাজ্যবাদী রাজা 'মং ওয়াইং' ওরফে 'বোদফারাহ' স্বাধীন আরাকান আক্রমণ করেন এবং আরাকানের তৎকালীন নির্বাচিত রাজা 'থামাদা'কে হত্যা করে সমগ্র আরাকান দখল করে নেন। পরবর্তীকালে বর্মি সেনাপতি 'বেনদুলা'র নেতৃত্বে পরাজিত আরাকানি তথা রাখাইনদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ১৭৮৫ থেকে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ৪ বছরে দখলদার বর্মি সেনাবাহিনী বর্বরোচিতভাবে প্রায় আড়াই লাখ নিরীহ রাখাইনকে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে আরাকানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী তাদের পিতৃভূমি আরাকান থেকে পালিয়ে এসে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। পালিয়ে আসা এসব শরণার্থীর পুনর্বাসন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকে সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োগ করেন। পুনর্বাসন কার্যক্রম চলাকালে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্স স্থানীয়ভাবে একটা বাজারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার পরিচিতি ছিল 'কক্স সাহেবের বাজার' নামে। দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাজারসহ পুরো এলাকাটাই 'কক্সবাজার' নামে পরিচিতি লাভ করে। 'কক্সবাজার' নামের উৎপত্তির ফলে এর পুরোনো 'অং খ্যেং থা' নামটি কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই কক্সবাজার নামটি রাখাইনদের কাছে 'ফলং জিঃ' নামেই পরিচিত যার অর্থ শ্বেতাঙ্গ সাহেবের বাজার। তবে উচ্চারণগত বিকৃতির কারণে রাখাইনদের 'ফলং জিঃ' আজ 'ফলং খ্যি'-তে ঠেকেছে।
অসংখ্য মতভেদ আর গবেষণার পরও কালের স্রোতধারায় কিংবদন্তি হয়ে সকল নাম তলিয়ে গেছে সভ্যতার গহ্বরে। সবশেষে ক্যাপ্টেন হাইরাম কক্সকে চিরসম্মানিত করে তাঁর নামেই বর্তমানে 'কক্সবাজার' ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে।

[পুনশ্চ : এই ফিচারটি আমারই লেখা, যা জাতীয় দৈনিক 'ভোরের কাগজ'-এর ৩১ আগস্ট ১৯৯৮ সংখ্যার পৃষ্ঠা-৫ ফিচার পাতায় ছাপা হয়েছিল। তখন কক্সবাজার জেলার থানা/উপজেলার সংখ্যা ছিল ৭টি। বর্তমানে পেকুয়াসহ ৮টি। আমি তখন প্রচলিত 'রাখাইন' বানানটি না লিখে উচ্চারণ অনুযায়ী 'রাখাইং' লিখতাম।]

কোন মন্তব্য নেই: