১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সেই রাতে আরও ২৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ৩টি হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধুর ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা ও মোহাম্মদপুরের কামানের গোলায় হত্যাকাণ্ড_এই ৩টি হত্যা মামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছে। জোট সরকারের সময়ে এই মামলাগুলোকে স্থগিত ও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ আদালতে বিচার অনুষ্ঠিত হলেও সেই রাতে এই ৩ হত্যা মামলায় ২৪ নিহত হওয়ার বিচার আজ অবধি হতে দেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের পিতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিকে '৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ভোরে হত্যা করা হয়েছে ধানমণ্ডির বাসভবনে। এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে থানায় মামলা হয়। মামলাটি তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডিকে। সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে এই মামলার তদন্তকারী অফিসার নিযুক্ত করা হয়। জোট সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও জোট সরকারের প্রত্যাহার করে নেয়া শেখ মনি হত্যা মামলাটি পূর্বাবস্থায়ই রয়ে গেছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
শেখ মনি হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলা মামলা সাজানো নাটকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তিনি সিআইডি থেকে ইতোমধ্যেই অবসর নিয়েছেন। তারপর থেকে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সর্বোচ্চ আদালতে রায় ঘোষণার পর শেখ মনি হত্যা মামলাটির খোঁজ করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর ভগি্নপতি সাবেক পানি, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ ৮ জন নিহত হন মিন্টু রোড্রে তার সরকারী বাসভবনে। সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পিতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে স্থগিত অবস্থায় আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত খুনীদের পক্ষে আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থাগিতাদেশ দিয়ে রাখা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে উচ্চ আদালতে এই স্থাগিতাদেশ হয়।
'৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে সাবেক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টু রোডের সরকারী বাসভবন আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার খুনীরাসহ উচ্ছৃক্মখল সেনাসদস্যরা। অস্ত্রের মুখে বাসার ভেতরে ঢুকে বাসার সবাইকে একত্রিত করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি চার বছরের শিশু বাবু সেরনিয়াবাত, চাচাত ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, বাসার গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা, কাজের ছেলে পোটকা, আবদুর রহিম খান ওরফে রিন্টু। শিশু বাবু হচ্ছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে।
'৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদাসহ অন্যদের আসামি করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত শেষে '৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৬ সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়। চার্জশীট দাখিলের পর মামলাটি বিচারের জন্য আদালতে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে উচ্চ আদালতে আবেদন জানানোর প্রেক্ষিতে মামলাটি বিচারের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।
'৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময়ে খুনীদের কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হলে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শের শাহসুরি রোডের ৮ ও ৯ নম্বর বাড়িতে গিয়ে পড়ে। গৃহিণী রোজিয়া বেগম, তার ছোট মেয়ে নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম-১, আনোয়ারা বেগম-২, ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ্, রফিকুল, সাবিয়া, সাহাবুদ্দিন, আমিনুদ্দিন, কাশেদা ও দুই বছরের শিশু আনোয়ারা মারা যায়। '৯৬ সালের ২৯ নবেম্বর রোজিয়ার স্বামী মোহাম্মদ আলী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালে সিআইডি এই হত্যা মামলাটি তদন্ত করে চার্জশীট দেয়। চার্জশীটে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়। তারপর থেকে এই মামলাটির ন্যায় বিচারের আলোর মুখ দেখতে দেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শেখ মনি হত্যা মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছিল সিআইডিকে। সিআইডির তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে। মুন্সি আতিকুর রহমান সিআইডি থেকে অবসরে চলে গেছেন। জোট সরকারের আমলে শেখ মনি হত্যা মামলাটির তদন্ত স্থগিত করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালতে ঘোষিত হওয়ার পর এখন শেখ মনি হত্যা মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম নতুন করে শুরু করতে আর কোন বাধা নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে স্টে করে রাখা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে খুনীদের পক্ষে আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি স্থগিত করে রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে খুনীদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখার পর এখন এই মামলাটির স্থগিতাদেশ ভেকেন্ট করার আবেদন করে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ করে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হওয়ার পর '৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই রাতে মোহাম্মদপুরে কামানের গোলায় হত্যাকাণ্ড, শেখ মনি হত্যাকাণ্ড ও আবদুর রব সেরনিয়াবাত_এই ৩ হত্যা মামলার পুনর্তদন্ত ও পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন