সোমবার, অক্টোবর ২২, ২০১২

আমাদের গড় মানসিকতা, মানবিক মানুষ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা

ঘটনা ০১

সেদিন সহধর্মিণীর সাথে কথা বলছিলাম সেলফোনে। কথোপকথন চলছিল আমাদের (রাখাইন) মাতৃভাষায়। সেলফোনের মাধ্যমে বলা আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আমার সামনে বসা বাঙালি ভদ্রলোকটি। কথোপকথন শেষ হওয়ার পর তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন,
  • কী ভাষায় কথা বললেন দাদা, একটা শব্দও বোধগম্য হয়নি।
  • আমাদের মাতৃভাষায়, মানে রাখাইন ভাষায়।
  • বাংলায় বললে কী অসুবিধে ছিল দাদা? 
  • আমি তো আপনার সঙ্গে বাংলায় বলছি। কিন্তু যাঁর সাথে এতক্ষণ সেলফোনে কথা বললাম, তিনিও আমার মতো রাখাইন। সুতরাং, নিজেদের মাতৃভাষায়, মানে রাখাইন ভাষায় কথা বলাই তো যুক্তিসংগত।
  • না, মানে বাংলায় বললে আমরাও বুঝতে পারতাম আর কি …

 
ঘটনা ০২

বছর পনেরোর আগে আমার শ্যালিকা ও তার বান্ধবীদের নিয়ে কক্সবাজার শহরের পর্যটন মোটেল শৈবাল-এর পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের ফাঁকে-ফাঁকে ফোটো সেশন করছিলাম, একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জন্য। শ্যালিকা ও তার বান্ধবীদের ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাক দেখে সেখানে উপস্থিত দেশি এক পর্যটক জানতে চাইলেন,
  • মেয়েদের পোশাক এ রকম কেন দাদা?
  • রাখাইন মেয়েরা তো এ ধরনের পোশাকই পরে।
  • শাড়ি পরলে আরও সুন্দর দেখাত।
  • কেন, শাড়ি পরতে যাবে কেন তারা?
  • বাংলাদেশে বসবাস করছেন যখন, শাড়ি পরলে অসুবিধে কী দাদা? আমরা তো সবাই বাঙালি …
  • না, আমরা বাঙালি নই। কারণ, নিজেদের (সম্প্রদায়ের) মধ্যে আমরা বাংলায় কথা বলি না। তবে বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমরা বাংলাদেশি। 

 
ঘটনা ০৩

বছর দুয়েক আগে এক বিদেশি কোম্পানির উৎপাদিত জুতায় গৌতম বুদ্ধের ছবি ব্যবহার করায় এর প্রতিবাদ স্বরূপ একটা লেখা লিখেছিলাম তিনটে বাংলা কমিউনিটি ব্লগ সাইটে। সেখানে বিশেষ তিন-চারজন ব্লগারের মন্তব্য ছিল নিম্নরূপ:
  1. জুতায় কারও (বুদ্ধ) ছবি লাগালে যদি ভঙ্গুর ধর্ম ভেঙে যায়, তা হলে ধর্ম পালন না করাই উত্তম।
  2. ধার্মিকদের ধর্মানুভূতি (নারী) সতীচ্ছদের মতোই ভঙ্গুর ... এখানে কীভাবে বৌদ্ধ ধর্ম বা বুদ্ধকে অবমাননা করা হল, বুঝিয়ে বলবেন কি?
  3. জুতায় ছবি অবমাননার উদ্দেশ্যে দেয়নি, ব্যবসার উদ্দেশ্যেই দিয়েছে ... ওনারা কোনো ভুল করেননি, জুতা বানানোর স্বাধীনতা সবার আছে।
  4. ... কিন্তু এটা (বৌদ্ধ ধর্ম) কি কোনো ধর্ম (হল)? ঘরবাড়ি ছাড়া একজন সন্ন্যাসী ধর্মের প্রবর্তক হয় কীভাবে? জীবনমুখিতা কি কোনো ধর্ম? তার প্রবর্তিত ধর্মের আইডিওলজি কী, বলুন তো দেখি ...

উপরে যাঁদের সংলাপ ও মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা সবাই প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত। শুধু শিক্ষিতই নন, বলা উচিত উচ্চশিক্ষিত। আর উচ্চশিক্ষিতরা যদি এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন, তা হলে স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মানসিকতা কী রকম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

আসলে ব্যক্তি মানুষের মানসিক গঠন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারাই উৎকর্ষতা লাভ করে না বা পরিপূর্ণতা পায় না। মানুষের বেড়ে ওঠার পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশই একজন মানুষকে মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে বলে আমার ধারণা এবং বিশ্বাস। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বিদ্যমান সার্বিক পরিবেশ কিন্তু ব্যক্তি মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের সহায়ক নয় মোটেই। আর এই বিরূপ পরিবেশের মধ্য থেকে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ আপনা-আপনি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে, এই আশা করাটাও বাতুলতা মাত্র।

অন্যের কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস বা আনুষঙ্গিক উপাচার ইত্যাদিকে ছোট কিংবা হেয় করে দেখার এই মানসিকতা কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। এ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠেছে মূলতঃ গণ্ডিবদ্ধ চর্চার কারণে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চাইলে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেবল লালন আর চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এসবের সমান্তরাল অধ্যয়নও করে যেতে হবে। অন্যের ধর্ম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের প্রয়োজন আরও বেশি। বর্তমান অভিভাবকরা হচ্ছেন সেই প্রজন্ম, যাঁরা কেবল চর্চাই করেছেন, কিন্তু অধ্যয়ন করেননি। তাই পূর্বসূরিদের এই সংকীর্ণ মানসিক গঠন নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা যেন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে না বসে সেদিকে খেয়াল রাখার সময় বোধহয় আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি। আরও দেরি করলে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, সেসব তিলে-তিলে ধ্বংস হয়ে জাতি একদিন সম্মিলিত ও স্বকীয় চেতনাহীন হয়ে পড়বে। তখন জাতি কী নিয়ে আর গর্ব করবে?

লেখাটা শেষ করছি আমার সাম্প্রতিক একটা স্ট্যাটাস দিয়ে, আমরা যারা সচেতন বলে দাবি করি, তারা যদি কথায় ও কাজে মিল রেখে সততা এবং সৎ সাহস নিয়ে নিজ-নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করি, তা হলে এ নষ্ট সমাজ একদিন উঠে দাঁড়াবেই। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ...

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০১২

প্রসঙ্গ: আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান

বর্তমান জাতীয় সংসদে পাঁচ-পাঁচজন আদিবাসী সদস্য রয়েছেন, তার পরও কেন আদিবাসী শব্দটির স্বীকৃতি মেলেনি? এই পাঁচজনের দু'জন (মি. দীপঙ্কর তালুকদার এবং মি. প্রমোদ মানকিন) আবার বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ উদযাপন/পালন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একেবারে প্রথম অবস্থা অর্থাৎ সেই ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এই পাঁচজন মাননীয় সংসদ-সদস্য (ব্যাকরণ অনুযায়ী একজন কিন্তু সদস্যা) মহান জাতীয় সংসদে কার বা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন?

উচ্চারণসহ রাখাইন বর্ণমালা
আমার জানামতে, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায় না, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে (এনজিও পরিচালিত পাঠশালায়) কোনো-কোনো এলাকায় আদিবাসী শিশুরা (বিশেষ করে চাকমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের) মাতৃভাষায় বর্ণমালা শেখার সুযোগ পাচ্ছে। বান্দরবানে কোটি টাকা মূল্যের মারমা ভাষার বর্ণমালা ও শিশুপাঠ্যবই মহল বিশেষের অনীহার (বলা যায় ইচ্ছাকৃত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি) কারণে দীর্ঘদিন ধরে গুদামে পড়ে আছে বলে পাণ্ডুলিপি ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।


এ প্রসঙ্গে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সমতলের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কথা যদি বলি, তা হলে বলতে হয় অবস্থা আরও করুণ। পাহাড়ি এলাকার মতো এখানে এনজিওদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো কার্যক্রমই পরিলক্ষিত হয় না। অথচ সমতলের বিশেষ-বিশেষ এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা পাকিস্তান আমলে চালু ছিল।
লেখার নির্দেশসহ রাখাইন বর্ণমালা

এখানে উল্লেখ্য, আমার নিজ বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। আমার জানামতে তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার ৭ কিংবা ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখাইন শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এমন-কী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দু'-তিন বছর চালু ছিল। আমি নিজেও প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীতে মাতৃভাষার বই (সহপাঠ হিসাবে) পড়েছি। পরে এই কার্যক্রম কেন যে বন্ধ হয়ে গেল, বোঝা গেল না। এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছিল এলাকাভিত্তিক এক-একটি ... বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে (যেমন: আমি পড়েছিলাম হারবাং বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-এ, এটি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নে অবস্থিত)। তখন এসব বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-এ বাঙালি শিক্ষকের পাশাপাশি ন্যূনতম একজন রাখাইন শিক্ষক নিযুক্ত থাকতেন। এসব বিদ্যালয়ের নাম এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে, শিক্ষাদানের কার্যক্রমও পুরোদমে চলছে, রাখাইন শিশুরাও এখন বেশি-বেশি করে পড়ছে এবং সর্বোপরি রাখাইন শিক্ষকও নিয়োজিত আছেন। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এই, এসব বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-এ রাখাইন শিক্ষার্থীদের আর মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না।

শনিবার, অক্টোবর ২৯, ২০১১

মানসপটে আবদুল হক চৌধুরী

আবদুল হক চৌধুরী
[২৬ অক্টোবর ছিল চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস। তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা -র ১০ নভেম্বর ১৯৯৪ তারিখের সংখ্যায় আমি তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি তাঁর প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ এখানে হুবহু তুলে দিলাম।]

২৭ অক্টোবর ১৯৯৪, বৃহস্পতিবার বিকালে বেতার ভবনের বার্তা কক্ষে গিয়ে সেদিনের দৈনিক আজাদী পত্রিকাটি পড়ার জন্য চোখের সামনে মেলে ধরলাম। প্রথম পৃষ্ঠার এক জায়গায় আমার চোখ আটকে গেল। বড়-বড় অক্ষরে লেখা চট্টগ্রামের খ্যাতিমান গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আর নেই। হেডিংটা পড়েই কতক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলাম বলতে পারব না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি মুচড়ে উঠল। পরে প্রকৃতিস্থ হয়ে পুরো নিউজটা পড়লাম। পুরো নিউজটা পড়ে বুঝলাম ততক্ষণে তাঁর মৃতদেহ দাফন করা হয়ে গেছে। একটুও জানান না দিয়ে প্রচার বিমুখ গুণীব্যক্তিটি এভাবে চলে গেলেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বই-কী। সেদিন নানা ব্যস্ততার কারণে বিকাল অবধি কোনো দৈনিকই পড়ে হয়ে ওঠেনি। আমার আফশোস, সকালেও যদি জানতাম তা হলে ডিসি রোডস্থ মনীষা -য় না হোক অন্তত মহসিন কলেজ মাঠে হলেও তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে পারতাম। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে পারলাম না, এ দুঃখবোধ চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।

মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১-এর মাঝামাঝি সময়ে। পরিচয়ের মাধ্যম ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের প্রাক্তন উপ-মুখ্য প্রযোজক ও আমার অগ্রজপ্রতিম প্রয়াত উ চ নু (উ বা)। পরিচয়ের পর থেকে আরাকান বিষয়ক গ্রন্থ ও তথ্যের প্রয়োজনে তিনি ডিসি রোডস্থ আমার বাসায় মাঝে-মধ্যে আসতেন। আমিও তাঁর বাসভবন মনীষা -য় যেতাম মাঝে-মধ্যে। তখন আমার সঙ্গে থাকতেন মিরসরাই ডিগ্রি কলেজের (তৎকালীন) প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) মং উ সাং। আমি এবং প্রভাষক মং উ সাং আরাকানের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকে মাঝে-মধ্যে লিখে থাকি। তাই মরহুম আবদুল হক চৌধুরী ও আমাদের দু'জনের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক হতে বেশিদিন লাগেনি। মরহুম চৌধুরীর লেখা চট্টগ্রাম নামের নতুন উৎস এবং চেরাগী পাহাড় নামের নতুন উৎস শীর্ষক নিবন্ধ দু'টির তথ্যপঞ্জিতে প্রয়াত উ চ নু (উ বা) এবং প্রভাষক মং উ সাঙের নাম উল্লেখ রয়েছে। তাঁর রাউজান নামের নতুন উৎস নিবন্ধটি লেখার সময় তাঁকে আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জোগান দিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, মরহুম আবদুল হক চৌধুরী আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন, বয়সে তিনি আমার প্রয়াত জনকের কাছাকাছি। তাই তাঁকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। জীবদ্দশায় তিনি যতবার আমার বাসায় এসেছিলেন, প্রত্যেকবারই আসতেন খুব ভোরে। এসে নীচ থেকে মং হ্লা, মং হ্লা কিংবা পিন্টু, পিন্টু বলে ডাকতেন নয় তো সরাসরি উপরে এসে দরজায় নক করতেন। একবার খুব ভোরে (দিনটা ছিল সম্ভবত একুশে ফেব্রুয়ারি) এসে বললেন, চলো, তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব । তাঁর কথানুযায়ী তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরোলাম। নিয়ে গেলেন আলমাস সিনেমা হলের কাছে এক বাসায়। ওটা ছিল খ্যাতিমান চিত্রকর মুর্তজা বশীরের বাসা। সেখানে শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীরের সংগৃহীত দু-একটি আরাকানি (পঞ্চদশ শতকের) মুদ্রার গায়ে উৎকীর্ণ আরাকানি তথা রাখাইন লিপির পাঠোদ্ধার করতে হল আমাকে।

পরিশ্রমী গবেষক মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর লেখা বেশ ক'টি দীর্ঘ নিবন্ধের কপি করে দিয়েছিলাম আমি বাংলা একাডেমী পত্রিকা -র জন্য। তা ছাড়া বাংলা একাডেমী থেকে সদ্য প্রকাশিত তাঁর প্রচীন আরাকান: রোয়াইঙ্গ্যা, হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী গবেষণা গ্রন্থে যতগুলো আরাকানি বৌদ্ধ তথা রাখাইন রাজার নাম রয়েছে সেগুলোর (পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার আগে) সঠিক বানান (রাখাইন উচ্চারণ অনুযায়ী) লিখে দিয়েছিলাম। বছর দুয়েক আগে আমার প্রয়োজনে কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থটা দু-একদিনের জন্য ধার চাইতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসভবনে অর্থাৎ মনীষা -য়। সেদিন আমাকে বললেন যে, রাখাইন সম্প্রদায় সম্পর্কিত তিনটি লেখা তাঁর প্রয়োজন। লেখাগুলো হচ্ছে-- জন্ম, বিয়ে এবং মৃত্যু সম্পর্কিত। তন্মধ্যে ইতিপূর্বে একটা মাসিকে প্রকাশিত রাখাইন সমাজে বিয়ে শীর্ষক আমার লেখাটা তিনি সংগ্রহ করেছেন বলে জানালেন। বাকি রইল জন্ম এবং মৃত্যু অর্থাৎ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কিত দু'টি লেখা। লেখা দু'টি শীঘ্রই তৈরি করে দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে তাগাদা দিলেন। তাঁর কথানুযায়ী আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং মাউইয়ের (মাসি) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে রাখাইনদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শীর্ষক লেখাটি তৈরি করলাম এবং একটা দৈনিকে পাঠিয়ে দিলাম। পরে ওই পত্রিকার ফোটোকপি তাঁর অর্থাৎ মরহুম চৌধুরীর কাছে দিয়ে এলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি বলে রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্ম বিষয়ক লেখাটা এতদিন তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি আমি এ সম্পর্কিত সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। কিন্তু লেখাটা তৈরি করার আগেই তিনি অকস্মাৎ চলে গেলেন। একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মরহুম আবদুল হক চৌধুরীর প্রয়োজনেই আমি লেখাটা তৈরি করতে চেয়েছিলাম। এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভসঞ্চার থেকে শুরু করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় রীতিনীতির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নোট করে রাখলাম। কিন্তু লেখাটা ছাপানো আকারে তাঁর হাতে তুলে দিতে পারলাম না। এ অপারগতা আমাকে চিরদিন খোঁচা দেবে।

শ্রদ্ধেয় আবদুল হক চৌধুরী আলাপকালে প্রায়ই বলতেন যে, আমাদের অর্থাৎ আমি এবং প্রভাষক মং উ সাঙের সঙ্গে অন্তত আরও পাঁচ বছর আগে পরিচিত হলে ভালো হত। তা হলে আরাকানের ইতিহাস আরও তথ্যসমৃদ্ধ এবং বিস্তারিত আকারে লিখতে পারতেন। আমাদের সঙ্গে আরও আগে পরিচিত না হওয়ায় তিনি সবসময় আক্ষেপ করতেন। মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে একটা সংকলনের সৌজন্য কপি পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর বাসভবনে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সেদিন বললেন, আমার হার্টের অসুখ। কয়েকদিনের মধ্যে ভারত যাব, চিকিৎসা করানোর জন্য। তার পর ফিরে এসে কক্সবাজার যাব। কক্সবাজারে গিয়ে প্রত্যক্ষ করব তোমাদের (অর্থাৎ রাখাইনদের) সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণ । কিন্তু তাঁর আর কক্সবাজার যাওয়া হল না।

স্কুল জীবনে তাঁর গ্রন্থের (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি) সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর ওই গ্রন্থ পড়েই আমি আমার পিতৃভূমি আরাকান সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানি। পরবর্তীতে তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ সংগ্রহ করেছি এবং পড়েছি। অস্বীকার করব না, আরাকানের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন এবং লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে মরহুম আবদুল হক চৌধুরী অন্যদের তুলনায় বহুগুণে নিরপেক্ষ। তাই আমি প্রয়োজনে তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকি।

ব্যক্তি আবদুল হক চৌধুরী আজ আমাদের মাঝে নেই তা সত্য। কিন্তু তাঁর পরিশ্রমের ফসলগুলো আমাদের বুক-শেলফগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। তিনি তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।

রবিবার, অক্টোবর ০২, ২০১১

কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ 'রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়'

বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্নশিক্ষার হার অধ্যুষিত মফস্বল শহর হচ্ছে কক্সবাজার। পর্যটননগরী কক্সবাজারের গোড়াপত্তন থেকে অদ্যাবধি এই অঞ্চলে শিক্ষার যতটুকু সম্প্রসারণ ঘটেছে তার মুখ্য ভূমিকায় রামু থানার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। কক্সবাজার জেলার (তৎকালীন মহকুমা) সর্বপ্রথম উচ্চ বিদ্যালয় এটি। রামুর তদানীন্তন ধনাঢ্য রাখাইন পরিবারের সন্তান প্রয়াত দানবীর পোয়েজা (বণিক অর্থে) উ-খিজারী এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।

উ-খিজারীর জন্ম (জনশ্রুতিতে) ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন বর্মি তথা রাখাইন ভাষায় একজন সুশিক্ষিত বোদ্ধা। বাংলা ভাষায়ও সমভাবে দক্ষ ছিলেন তিনি। বঙ্গবাসী হিসাবে তাঁর স্বদেশপ্রীতি ছিল অপরিসীম। কর্মজীবনে বণিক হলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তাই তখনকার অন্ধকার যুগেও উ-খিজারী ভাবতে পেরেছিলেন জন্মভূমিকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করবার কথা। তাঁর সেই দূরদর্শিতার ফল হচ্ছে আজকের এই রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।


২.৩৫ একর জমির উপর সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টি নির্মিত হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে ব্যয় হয় তৎকালীন মুদ্রায় ৭০ হাজার টাকা (বর্তমান অর্থাৎ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রায় হিসেব করলে দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা)। এই বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণশৈলীও ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এটি ছিল সম্পূর্ণ সেগুন কাঠের তৈরি। উ-খিজারী সুদূর রেঙ্গুন থেকে সিদ্ধ করা প্রচুর সেগুন কাঠ এবং সুদক্ষ কাঠমিস্ত্রী আনিয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত বৌদ্ধ প্যাগোডা স্টাইলের বিদ্যালয় ভবনটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবেই এটি তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার সর্বপ্রথম স্থাপিত উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করা হলেও বিদ্যালয়ের নথিপত্রে দেখা যায় যে, এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বার এট ল') এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক জনসভায় ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য রাখেন। ফলে বিদ্যালয়টি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পতিত হয়। বিদ্যালয়ের যাবতীয় সম্পদসহ বিদ্যালয়টিকে স্থানান্তর করা হয় মহকুমা শহর কক্সবাজারে। বর্তমানে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের পূর্ব দিকে অবস্থিত জরাজীর্ণ কাঠের বেড়া ও টিনের ঘরটিই রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি ভগ্নাংশ।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের কাঁপন লাগে বিশ্বব্যাপী। তার অভিশাপ থেকে রেহাই পায়নি প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বিদ্যালয়টি। সামরিক বাহিনীর লোকেরা হুকুমদখল করে নেয় বিদ্যালয় ভবন এবং বিদ্যালয়ের মাঠ হয়ে ওঠে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ কেন্দ্র। ফলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা বর্তমান রামু চৌমুহনীর বাস স্টেশনসংলগ্ন দাঅং (বানানভেদে দং) দীঘির পূর্ব দিকে একচালাবিশিষ্ট একটি খড়ের ঘরে বেশ কিছুদিন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই বিদ্যালয়টির উপর একদিন নেমে এল বিরাট বিপর্যয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ। দুর্ঘটনাজনিত এক অগ্নিকাণ্ডে এই বিদ্যালয়টি ভস্মীভূত হয়ে যায় সম্পূর্ণভাবে। রামুবাসীর জন্য এই অপ্রত্যাশিত দৈবদশা চরম আঘাতের বেদনা বয়ে আনলেও সে বেদনায় মুহ্যমান হয়ে থাকেনি রামুবাসী। সর্বস্তরের জনগণ তাদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রসারিত করেছিল সাহায্যের হাত। মরহুম জাফর আলম চৌধুরীর প্রচেষ্টায় তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা অনুদান দিয়েছিলেন ২৫ হাজার টাকা (তৎকালীন মুদ্রায়)।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টি পুনঃনির্মাণের সময় ১২ কক্ষবিশিষ্ট ১৩৮ ফুট দীর্ঘ ও ২৮ ফুট প্রশস্ত একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ২ কক্ষবিশিষ্ট ৫০ ফুট দীর্ঘ ও ২৭ ফুট প্রশস্ত আরও একটি দ্বিতল ভবন এবং ৮২ ফুট দীর্ঘ ও ৩৬ ফুট প্রশস্ত একটি মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়।

রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভাঙাগড়ার ইতিহাসে প্রয়াত পোয়েজা উ-খিজারীর পর যাঁদের অবদান স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে মরহুম মেহের আলী বিএল অন্যতম। বিদ্যালয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যা করেছিলেন আজকাল তেমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও একক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক স্থানান্তরিত এই বিদ্যালয়টি উ-খিজারী প্রদত্ত যথাস্থাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আজও তিনি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে সম্মানিত ও স্মরণীয়। মরহুম মেহের আলী সাহেবের জীবদ্দশায় তাঁর এই মহান কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির এক সভায় জনৈক সদস্য বিদ্যালয়টিকে 'খিজারী-মেহের আলী উচ্চ বিদ্যালয়' নামকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করলে মেহের আলী স্বয়ং তৎক্ষণাৎ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, 'খিজারী বিদ্যালয়, খিজারী বিদ্যালয়ই থাকবে। খিজারীর নামের পাশে কারও নাম থাকতে পারে না।' তাঁর এই উক্তি তাঁর সাচ্চা হৃদয়ের নির্লোভ উদারতা ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মরহুম মেহের আলীর পর যাঁর অবদান স্মরণীয় তিনি হলেন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য মরহুম জাফর আলম চৌধুরী। রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামগ্রিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মরহুম জাফর আলম চৌধুরী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ বিদ্যালয়টি অপ্রত্যাশিত অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে গেলে তিনি বিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খানকে সশরীরে আমন্ত্রণ করে এনে বিপর্যস্ত বিদ্যালয়ের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন। যে কারণে প্রত্যক্ষদর্শী গভর্নর তৎক্ষণাৎ জরুরিভিত্তিতে ২৫ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদ্যালয়টি কেবল ৪ জন শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত হত। এই ৪ জন শিক্ষকের মধ্যে একমাত্র স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক ছিলেন বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অতিবাহিত করেছেন। অগ্নিকাণ্ডের পর বিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় মরহুম রশিদ আহমদ মাস্টার ও বিদ্যালয়ের দপ্তরী আতর আলীসহ বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনেক অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। শিক্ষকতার মহান ব্রতে নিবেদিত থেকে বাবু জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া জ্ঞান বিতরণ করেছেন জন্মভূমিকে অশিক্ষার অন্ধকার অতল থেকে সুশিক্ষার আলোর অভিমুখী করার স্বপ্নসাধনায়।

এই বিদ্যানিকেতনের শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে অনেকে অকাতরে দান করে গেছেন অবৈতনিক শিক্ষকতার মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম উল্লেখের দাবি রাখে তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, উ-মংক্যজ, মাস্টার ফরিদুল আলম, অধ্যাপক দীপক বড়ুয়া, মনমোহন বড়ুয়া, দয়াল হরি শর্মা, জুবায়ের আলম, জহিরুল আলম, অধ্যাপক শাহজাহান মনির প্রমুখ। এ ছাড়া যে দু'জনের কথা স্বীকার না করলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনায় ত্রুটি থেকে যাবে, তাঁরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক মরহুম রশিদ আহমদ ও দপ্তরী আতর আলী।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি সুদক্ষ, অভিজ্ঞ ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন জ্ঞানীগুণীদের অসাধারণ মেধায় পরিচালিত হয়ে আসছে এই বিদ্যালয়টি। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মতো জ্ঞানীর পরশে ধন্য হয়েছে এই বিদ্যালয়। এ ছাড়া আলতাফ মিঞা, শশীভূষণ ভট্টাচার্য, ব্রজমোহন সাহা, রমেশচন্দ্র গুপ্ত, আলী আহমেদ, নিকুঞ্জবিহারী নন্দী, জহির উদ্দিন, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী, ফজলুর রহমান, বিভূতিভূষণ সেন, কাসেম আলী, শেখ আবু আহমেদ, সুরেশচন্দ্র দেব, মমতাজউদ্দিন আহমদ, জাকেরউল্লাহ্, মাহমুদুল হক, অমরনাথ ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ আমির, আক্তার আহমদ ও নন্দিত সংগীতজ্ঞ জগদানন্দ বড়ুয়ার মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বরা শিক্ষাক্ষেত্রে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবদানকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছুতে অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে অদ্যাবধি জাতীয়করণ করা হয়নি।

[লেখাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় বাংলা দৈনিক 'সংবাদ'-এর ২৯ এপ্রিল ১৯৯৩ (মোতাবক ১৬ বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ) তারিখের সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি রামুর সাহিত্যসেবী আশীষ কুমার এবং আমি যৌথভাবে তৈরি করেছিলাম। এখানে হুবহু কম্পোজ করে তুলে দেওয়া হল।]

রবিবার, নভেম্বর ১৪, ২০১০

যেভাবে বাড়ি ও সুযোগ-সুবিধা

৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বেগম জিয়া ও তার দুই ছেলেকে গুলশানে প্রায় তিন একর জায়গার ওপরে বাড়িসহ বিপুল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের ৬ নম্বরের বাড়িটিও লিজ দেওয়া হয় সেনানিবাস কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৯ উপেক্ষা করে শুধু মানবিক কারণে তাদের এ সুযোগ-সুবিধা দেন তখনকার কর্তাব্যক্তিরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক করে বিপুল পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ কোনো রাষ্ট্রপতি কর্মরত থাকা অবস্থায় মারা গেলে বা নিহত হলে তার পরিবার কী সুযোগ-সুবিধা পাবে তাও কিন্তু সুস্পষ্টভাবে আইনে উল্লেখ আছে। প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৯ তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে জিয়াউর রহমানের পরিবার কি ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন। কিন্তু তারপরও মন্ত্রিসভা বৈঠক করে বিপুল সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করে।

জানা যায়, ১৯৮১ সালের ১২ জুনের ওই মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে দুটি নয়, একটি বাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খালেদা জিয়া সেই বাড়িও নিয়েছেন আবার সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়িটিও ছাড়েননি। আবার বাড়িটি লিজ নেওয়ার জন্যও আবেদন করেননি।

যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে : ১৯৮১ সালের ১২ জুন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে গুলশান মডেল টাউনে ১৯৬নং রোডের এনই (ডি) ৩বি নং বাড়িটি মাত্র ১০১ টাকা মূল্যে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে বেগম জিয়া ও তার দুই ছেলের কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া ওই বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, খালেদা জিয়াকে এককালীন ১০ লাখ টাকা অনুদান, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতির দেওয়া গাড়ির মূল্য বাবদ এক লাখ ৭৪ হাজার টাকাও দেওয়া হয়। বেগম জিয়ার জন্য একজন গাড়িচালক, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন বাবুর্চি, বেয়ারা দু'জন এবং মালি ও ঝাড়ুদারের একটি করে পদ সৃষ্টি করা হয়। সরকারি খরচে একটি টেলিফোন, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দেশে-বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন এবং তাদের বয়স ২৫ বছর না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার জন্য সরকারি একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়, যে গাড়ির জ্বালানি খরচ সরকার দেবে। এছাড়া বাড়ির গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিলও সরকার দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আর মইনুল রোডের ৬নং বাড়িটি এক টাকার বিনিময়ে পারমিচুয়াল লিজের মাধ্যমে কতিপয় শর্তে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল মূল্যে ইজারা দেওয়া হয়। তবে এ বাড়িটি লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে নেওয়া হয়নি।

আইনগতভাবে যা পাওয়ার কথা : জানা যায়, প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার প্রায় সবই ছিল বিধিবহির্ভূত। কারণ একজন রাষ্ট্রপতি কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে কি সুযোগ-সুবিধা তার পরিবার পাবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৯ তে। এ অর্ডিন্যান্সের ২(৪) ধারা অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়া এবং দুই পুত্রের শুধু গ্রাচুইটি পাওয়ার কথা। কাজেই প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিন্যান্স সংশোধন না করে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলে মনে করেন আইনবিদরা। সুবিধা দিতে হলে প্রেসিডেন্টস অর্ডিন্যান্স সংশোধন না করে দেওয়া যায় না বলে মনে করা হয়।

সেনানিবাসের বাড়ি : এছাড়া যে আইন বলে খালেদা জিয়ার মইনুল রোডের বাড়ি লিজ পাওয়ার কথা সেই আইনেই বলা আছে, লিজ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই আবেদন করতে হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া বাড়িটির লিজ পেতে আজও পর্যন্ত কোনো আবেদনই করেননি। আগে থেকেই তিনি যেহেতু বাড়িটিতে থাকতেন তাই আবেদন না করেই ৩০ বছর ধরে ওই বাড়িটিতেই আছেন।

জানা যায়, বাড়িটি লিজ দেওয়ার সময় আবেদন করতে বলার পাশাপাশি লিজের চুক্তিতেও কিছু শর্ত ছিল। চুক্তিতে এটাও উল্লেখ ছিল, ইজারাদার খালেদা জিয়া এসব শর্তের একটি ভঙ্গ করলেও সরকার চুক্তি বাতিল করার অধিকার সংরক্ষণ করবে। এসব শর্তের মধ্যে একটি শর্ত ছিল বাড়িটির মূল কাঠামো পরিবর্তন করে কিছু নির্মাণ বা কিছু ভাঙা যাবে না। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান মইনুল রোডের বাড়িটির ভেতরে একটি তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

সৌজন্যে : 'বাংলাদেশ প্রতিদিন', ১৪ নভেম্বর ২০১০, রবিবার

সোমবার, অক্টোবর ১১, ২০১০

বাইনারি এবং ডিজিটাল: দুজনে দুজনার!

খনো ভেবে দেখেছেন যে সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে আদ্যিকালের মানুষদের কেমন সমস্যায় পড়তে হতো? পিথাগোরাসের মতো গণিতবিদ কেন দুই-এর বর্গমূল বের করতে নাকানিচুবানি খেয়েছিলেন? কেনই বা আর্কিমিডিসের মতো মহারথী শেষতক পাই-এর মান দশমিকের পর মাত্র দুই ঘর পর্যন্ত সঠিকভাবে বের করে রণে ভঙ্গ দিলেন? রোমান সংখ্যা পদ্ধতি জেনে থাকলে বলুন তো, রোমান পদ্ধতিতে MMCXLVIII = ? বোধহয় জানেন যে এখানে M = 1000, C = 100, L = 50, X = 10, V = 5 এবং I = 1 বোঝাচ্ছে। কিন্তু এটুকু জানলেই তো হবে না। এই চিহ্নগুলো কোন অবস্থানে বসলে তার হিসাবটা কেমন দাঁড়াবে সেটাও জানা চাই। যেমন, এই উদাহরণে MMCXLVIII = 1000 + 1000 + 100 + 50 - 10 + 5 + 1 + 1 + 1 = 2148। কত জটিল একটি প্রক্রিয়া! দেখতে এমনিতেই বিদঘুটে, তার ওপর আবার মান বের করতে আরেক ফেঁকড়া—কখনো যোগ কখনো বিয়োগ, একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এমনতর সংখ্যাপাতন নিয়ে কাজ করতে গেলে তো পিথাগোরাসই হোক আর আর্কিমিডিসই হোক, সে যতই মহাপরাক্রমশালী গণিতজ্ঞ হোন না কেন, আজকালকের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীর কাছে পাটিগণিতের দৌড়ে গো-হারা হারবেন, তাতে আশ্চর্য কী!
 
আমরা এখন যে সংখ্যাপাতন ব্যবহার করি সেটা তবে কেমন? সেটা কি রোমান পদ্ধতির চেয়ে ভালো? ওই 2148-এর কথাই ধরুন। এখানে 2, 1, 4 এবং 8 চিহ্নগুলোর মানে কি তা আমরা ভালোই জানি। আমাদের সংখ্যাপাতনে ওই চিহ্নগুলোর একটা বিশেষ নাম আছে—অঙ্ক (digit)। রোমান সংখ্যাপাতনে যেমন কোন চিহ্ন কোথায় বসল সেটা খেয়াল করা জরুরি, তেমনি আমাদের সংখ্যাপাতনেও অঙ্কগুলোর অবস্থান জানা আবশ্যক, নতুবা সংখ্যাটার মান বের করা সম্ভব নয়। 2148-এর 2 এবং 4 যদি একে অপরের সঙ্গে জায়গা বদল করে তাহলে সংখ্যাটা পাল্টে 4128 হয়ে যায়। এমন কেন হয় তা বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে তাকাতে হবে। 1, 2, 3, 4, 5, 6, 7, 8, 9—এই পর্যন্ত এসে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অঙ্কের ভান্ডার ফুরিয়ে গেল। কারণ আমরা যেভাবে গুনতে শিখেছি সেখানে অঙ্ক আছে সর্বসাকল্যে দশটি। তাই উপায় না দেখে 9-এর পরে 10 বসাই। এখানে এক অঙ্কের সবচেয়ে বড় সংখ্যা 9-এর পরে চক্রাকারে 0 এসে জুটেছে, তবে একটা পুরো চক্কর ইতিমধ্যে যে দেওয়া শেষ তা বোঝাতেই ওই 0-এর বামে একটা 1 বসেছে। এভাবে 10, 11, 12, 13, ... 19-এর পরে গিয়ে আরেক চক্কর পুরো হওয়ায় 0-এর বামে একটা 2 বসে তৈরি করল 20। এমনিভাবে দুই অঙ্কের সবচেয়ে বড় সংখ্যা 99-এর পরে বসছে 100 এবং এভাবে অসীমতক চলছে তো চলছেই!
 
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোনো অঙ্কের ঠিক বাম পাশে যে অঙ্কটি বসছে সেটা আসলে প্রথমোক্ত অঙ্কটি কতগুলো চক্কর সম্পন্ন করেছে তার হিসাব দেয়। 2148-এর ক্ষেত্রে, সবচেয়ে ডানের 8 থেকে বোঝা যায় যে সেটি তার সর্বশেষ চক্করের পর আট ধাপ এগিয়েছে। তার বামে 4 নির্দেশ করছে যে দশ অঙ্কের চারটি চক্কর (4 × 10 = 40) সম্পন্ন করে অবশিষ্ট 8 তার ডানে বসেছে। একইভাবে 4-এর বামে 1 নির্দেশ করছে যে সেখানে একটি চক্কর সম্পন্ন হয়ে 4 বাকি রয়েছে। এটা যেহেতু বাম থেকে তিন নম্বর স্থান, তাই এখানকার এক চক্কর মানে হলো সর্বমোট 1 × 10 × 10 = 100 চক্কর। তাহলে আমরা যে সংখ্যাপাতন ব্যবহার করি সেখানে বিভিন্ন অঙ্ক তার অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন মান নেয়। 2148-এর মান বুঝতে হলে চক্করের হিসাবটা মাথায় থাকা দরকার। 2148 = (2 × 10 × 10 × 10) + (1 × 10 × 10) + (4 × 10) + 8
= 2 × 103 + 1 × 102 + 4 × 101 + 8 × 100

রোমানরা সংখ্যার বিভিন্ন চিহ্নের স্থানভিত্তিক মান বের করতে যে হরেক রকমের যোগ-বিয়োগের ব্যবসা ফেঁদেছিল, তার তুলনায় আমাদের সংখ্যাপাতন বেশ সাদামাটা। বাম থেকে যত নম্বর ঘর তার চেয়ে এক কম হবে দশের ঘাত (power) এবং এভাবে যা পাওয়া যাবে ওই ঘরে বসা অঙ্কের যা মান তার সঙ্গে গুণ করুন। তারপর এভাবে পাওয়া সবগুলো মান যোগ করতে হবে। দশটা চিহ্নেই কেল্লাফতে! অসীম পর্যন্ত সংখ্যা লেখা যাচ্ছে। রোমানদের সংখ্যা একটু বড় হলেই সেটাকে লেখার জন্য নিত্যনতুন চিহ্ন আমদানি করতে হতো।

প্রশ্ন হলো, আমাদের সংখ্যাপাতনে দশটার কম চিহ্ন ব্যবহার করে অসীমতক সংখ্যা লিখে যাওয়া সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব! বর্তমানে প্রচলিত সংখ্যাপাতনের যে বিশেষ রূপটি আমরা দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহার করি সেটায় চিহ্ন বা অঙ্ক দশটি, তাই এর আরেক নাম দশমিক বা দশভিত্তিক (decimal) সংখ্যা-পদ্ধতি। এই একই সংখ্যাপাতনে যেকোনো n সংখ্যক (n স্বাভাবিক সংখ্যা) চিহ্ন ব্যবহার করে n-ভিত্তিক সংখ্যা-পদ্ধতি বানানো যায়। উদাহরণস্বরূপ পাঁচভিত্তিক সংখ্যা-পদ্ধতি বানিয়ে দেখা যাক। পাঁচভিত্তিকে অঙ্ক পাঁচটি—0, 1, 2, 3 এবং 4। এর বাইরে আর কোনো অঙ্ক সেখানে ব্যবহার করা চলবে না। দশ ভিত্তিকে যেমন 9-এর পরে 10 বসল তেমনি পাঁচভিত্তিকে 4-এর পরে 10 বসবে। একটু অদ্ভুত লাগছে বটে, তবে দশ ভিত্তিকের 5 এবং পাঁচ ভিত্তিকের 10 একই সংখ্যা নির্দেশ করে! সাধারণভাবে বলা যায়, a1a2a3a4...ak যদি k অঙ্কবিশিষ্ট n-ভিত্তিক সংখ্যা হয় তাহলে তার মান হবে, a1 × nk–1 + a2 × nk–2 + a3 × nk–3 + ... + ak–1 × n1 + ak × n0
এটাই হলো আমাদের বহুল ব্যবহূত সংখ্যাপাতনের সাধারণ রূপ। এখানে n-এর মান দশ বসালে সেটা হবে দশ ভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থা, পাঁচ বসালে পাঁচ ভিত্তিক, ত্রিশ বসালে ত্রিশ ভিত্তিক, ষোল বসালে ষোল ভিত্তিক ... ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য দশের বেশি ভিত্তি নিয়ে কাজ করতে গেলে নতুন চিহ্ন আমদানি করতে হবে। যেমন: ষোলভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থার অঙ্কগুলো হলো 0, 1, 2, 3, 4, 5, 6, 7, 8, 9, a, b, c, d, e এবং f।

এখন প্রশ্ন হলো, আলোচ্য সংখ্যাপাতনে সবচেয়ে সরল সংখ্যা-পদ্ধতি কোনটা হতে পারে? যেটায় সবচেয়ে কমসংখ্যক চিহ্ন ব্যবহার করা লাগে, সেটাই নিশ্চয়ই সবচেয়ে সরল। সবচেয়ে সরল সংখ্যা-পদ্ধতি হলো দুই ভিত্তিক (binary) পদ্ধতি। বাইনারি গণনায় 1-এ এসেই দেখা যাচ্ছে আমাদের অঙ্কের ভান্ডার ফুরিয়ে গেল। কারণ বাইনারিতে অঙ্ক আছে সর্বসাকল্যে দুটি—0 এবং 1। তাই উপায় না দেখে 1-এর পরে 10 বসাই। এখানে এক অঙ্কের সবচেয়ে বড় সংখ্যা 1-এর পরে চক্রাকারে 0 এসে জুটেছে, তবে একটা পুরো চক্কর ইতিমধ্যে যে দেওয়া শেষ তা বোঝাতেই ওই 0-এর বামে একটা 1 বসেছে। এভাবে 10, 11-তে গিয়ে আরেক চক্কর পুরো হওয়ায় 0-এর বামে আরও একটা 0 বসে সেই চক্করও খতম করে তৈরি করল 100। দশ ভিত্তিকে যা 4, বাইনারিতে সেটাই 100। তারপর আসবে 101, 110, 111, 1000, 1001, ... এভাবে অসীমতক চলতে থাকবে। বাইনারিতে 101010-এর মান কত? উপরের সংখ্যাপাতনের ‘চক্করওয়ালা’ সাধারণ সূত্র হতে লেখা যায়, বাইনারিতে 101010 = 1 × 25 + 0 × 24 + 1 × 23 + 0 × 22 + 1 × 21 + 0 × 20 = 42। অর্থাৎ বাইনারিতে যা 101010, দশভিত্তিকে তা-ই 42।
 
বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে চারদিক কম্পিউটারে সয়লাব। এই কম্পিউটারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূলে আছে বাইনারি—1 আর 0, on আর off, বিদ্যুৎপ্রবাহের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি। বাইনারির ব্যাপারটা যদি না থাকত তাহলে আমরা কম্পিউটার বানাতে পারতাম না। কারণ হলো বিদ্যুতের কিংবা বিজলি বাতির মাত্র দুটি অবস্থা হতে পারে। আছে বা নেই, জ্বলে বা নিভে থাকে। এই আছে বা নেই দিয়ে যদি সব ‘কথা’কে প্রকাশ করা যায় তাহলেই কেবল বিদ্যুৎ দিয়ে ‘কাজ’ করার যন্ত্র বানানো সম্ভব। কম্পিউটার হোক বা মুঠোফোন হোক সবই এই এক আর শূন্যের ভোজবাজি। কম্পিউটারে টাইপ করার বেলায় একসেট ক্যারেক্টার ব্যবহূত হয়। প্রতিটি বর্ণ এক একটি ক্যারেক্টার, প্রতিটি বিরামচিহ্ন এবং কার-ফলা এক একটি ক্যারেক্টার, কিছু ক্যারেক্টার আছে যেগুলো চাপলে কম্পিউটারের পর্দায় সেটার জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিহ্ন ভেসে ওঠে না কিন্তু লেখার ধাঁচকে প্রভাবিত করে—সেগুলোও এক একটা ক্যারেক্টার। আমাদের দেশে প্রতিটি মুঠোবার্তার সর্বোচ্চ সীমা 160 ক্যারেক্টার, 160 বর্ণ নয়। এই ক্যারেক্টারগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য কম্পিউটারের ভেতরে বাইনারি পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়। আগে ছিল আসকি সংকেত আর এখন হয়েছে ইউনিকোড। দুটোতেই সব বর্ণকে এক আর শূন্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাজেই কম্পিউটারের কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ কারণে বাইনারি পদ্ধতিকে অনেকে ডিজিটাল পদ্ধতি বলে।
 
সবশেষে একটি প্রশ্ন। এই দুনিয়ায় 10 ধরনের মানুষ আছে—যারা বাইনারি বোঝে আর যারা বাইনারি বোঝে না। প্রিয় পাঠক, আপনি কোন দলে?

ডিজিটাল দিনের শুভেচ্ছা।
 
সৌজন্যে: প্রথম আলো (১০ অক্টোবর ২০১০, রবিবার)

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১০

আগে ছিল আশীর্বাদ (!), এখন অভিশাপ

৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে যখন ইস্যুটা শুরু হয় তখন মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান। পরে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার যখন একই ইস্যু নিয়ে দেশের পরিস্থিতি বেসামাল তখনকার সরকার প্রধান কিন্তু বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হন। বরং ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে সমস্যার স্থায়ী রূপ দেন। স্থানীয় শিক্ষিত বেকার, জনপ্রতিনিধি এবং আমলারা ওই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যাঁর-যাঁর আখের গুছিয়েছেন। কেউ-কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।

এখন কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ পরিবেশ বাঁচাও-পরিবেশ বাঁচাও বলে যে চিৎকার দিচ্ছেন তখন কেন তাঁরা দূরদৃষ্টি দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করেননি? এসব ভণ্ড পরিবেশবাদী, জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মীদের তখনকার আরাধ্য ছিল একটাই; তা হল, ওইসব অনুপ্রবেশকারীদের দেখভালের জন্য যে-সমস্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বাংলাদেশে আসন গেড়েছে সেগুলোয় চাকরি পাওয়া, নয় তো ঠিকাদারি জোগাড় করা। ওইসব অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছে আমাদের দেশপ্রেমিক (!) জনপ্রতিনিধি আর আমলাদের কল্যাণে। এখন প্রবাসে তাদের অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের।

এবার বুকে হাত দিয়ে ভেবে দেখুন তো আমরা কতোটুকু দেশপ্রেমিক, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং বিচক্ষণ?

রবিবার, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১০

এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি মতিউর রহমান প্রসঙ্গ এলে প্রথম আলোও আপনা-আপনি চলে আসে। তিনি যেভাবে ভোরের কাগজ থেকে দলবলসহ বেরিয়ে এসে প্রথম আলো জন্ম দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে একে শীর্ষস্থানে নিয়ে এসেছেন তাতে করে আমার বিবেচনায় মতিউর রহমানকে প্রথম আলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর থেকে প্রথম আলো যেভাবে সোচ্চার (যেমন: ফলো-আপ রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এবং মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে) হয়েছে অন্য কোনো পত্রিকা কি সে রকম সোচ্চার হয়েছে?

সেই সফল সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পর্কে কিনা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন! মতিউর রহমানের দিকে সন্দেহের আঙুল তুলেছেন কে বা কারা? অভিযোগটা কি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের পক্ষ থেকে, না কি বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে?

সোমবার, আগস্ট ৩০, ২০১০

'উপজাতি না আদিবাসী ?'


পর্যুক্ত শিরোনামটি আমার দেওয়া না, সিকদা৭১ এর কাছ থেকে ধার নেওয়া। সিকদা৭১ এই শিরোনামে গত ২৫ আগস্ট একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসাবে আমিও উক্ত পোস্টে একটি মন্তব্য করেছিলাম। আমার মন্তব্যের সূত্র ধরে পোস্টদাতা এবং পরে আমারসহ অন্যান্য ব্লগারের আরও যে-সব মন্তব্য এসেছে সেগুলো নীচে কপি-পেস্ট করে (বাঁকা হরফে) দিলাম:

মং হ্লা প্রু পিন্টু ২৫ আগস্ট ২০১০, ১৪:৫২
আপনার পোস্টটি পড়ে আমার ধারণা হল, আদিবাসী বলুন কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীই বলুন আপনি তাদের উপজাতি বানিয়েই ছাড়বেন। বাংলায় উপজাতি শব্দটা নিশ্চয়ই কোনো ইংরেজি শব্দ থেকে এসেছে, তাই না? এবার দয়া করে বলুন, কোন ইংরেজি শব্দ থেকে অবমাননাকর এই উপজাতি শব্দটা এসেছে। তার পর আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করব।

সিকদা৭১ ২৫ আগস্ট ২০১০, ১৫:২৩

আপনি হয়ত না কিন্তু আপনাদের স্বজাতি যেভাবে বিদেশের মাটিতে বাংগালীদের তথা বাংলাদেশিদের আত্যাচারি বানিয়ে যে ভাবে প্রপাগান্ডা চালাছ্ছে তা কি মেনে নেওয়া যায়?এতে আমার মত কেউ যদি দেশ প্রেমের কারনে কিছু সত্য তথ্য যদি তুলে ধরে তা কি অন্যায়?

মং হ্লা প্রু পিন্টু ২৫ আগস্ট ২০১০, ১৬:০৭
আপনি কিন্তু আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।

আপনাদের স্বজাতি, এখানে আমার বা আমাদের স্বজাতি বলতে আপনি কাদের বুঝিয়েছেন ঠিক বোধগম্য হল না। ধরে নিচ্ছি, আপনি চাকমাদের বুঝিয়েছেন। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারাই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বেশি নিয়েছে কিংবা পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শিক্ষাবৃত্তির বলতে গেলে ৯৯ শতাংশই চাকমাদের দখলে। আর এগুলোর বেশির ভাগ হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয়েছে খুব কম।
সে যা-ই হোক, উপজাতি কন্সেপ্ট বা ধারণা নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি উপজাতি শব্দের ঘোর বিরোধী।

নিজাম কুতুবী ২৫ আগস্ট ২০১০, ১৯:১৩
উপজাতি না আদিবাসী ?
কোনটাই নয়
আমরা সবাই বাঙ্গালী

মং হ্লা প্রু পিন্টু ২৫ আগস্ট ২০১০, ১৯:৩৫

নিজাম ভাই, কিছু মনে করবেন না। এখানেও (আপনার ওই বাক্যের ব্যাপারে) আমার দ্বিমত আছে।
দ্বিমতের প্রধান কারণ, আমি বাংলা ভাষাভাষির লোক নই অর্থাৎ আমার মাতৃভাষা বাংলা নয়।

পলাশমিঞা ২৫ আগস্ট ২০১০, ২০:১০
অনেক কিছু আজ জানলাম।

সাইদুর রহমান চৌধুরী ২৬ আগস্ট ২০১০, ০২:৩৩

যে বা যারাই এই 'উপজাতি' শব্দটির প্রচলন করেছেন তাঁরা এটা মাথায় আনেননি যে শব্দটি যাদের উদ্দেশ্যে ব্যবহুত হচ্ছে তাঁদের জন্য অসম্মানজনক, কারন 'উপ' দিয়ে কম, অধস্তন বা নিম্নমানের এরকম বোঝানো হয়। কাজেই উপজাতি বললে জাতির-উপ হয়ে যায়, সে হিসাবে ইংরেজি ট্রাইব এর বাংলা হিসাবে 'উপজাতি' যথাযথ শব্দ হয়নি, এটা ব্যবহার করাও অনুচিত মনে করি।
ট্রাইব-এর যে নৃতাত্ত্বিক সঙ্গা, তাতে আমাদের দেশের এই জাতিসত্ত্বাসমূহ ট্রাইবই, ইংরেজিতে ট্রাইব শব্দটি অসম্মানজনকও নয়, কিন্তু তার বাংলা 'উপজাতি' করলে তা অসম্মানজনক হয়ে যায়।

মং হ্লা প্রু পিন্টু ২৬ আগস্ট ২০১০, ১২:৩৪

সাইদ ভাই, আপনি ট্রাইব-এর সংজ্ঞা টানতে গিয়ে নৃতাত্ত্বিক প্রসঙ্গটি টেনেছেন, এবং টেনে আমাদের ( ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ) ট্রাইব অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। আমার মতে, এ ব্যাপারেও বিস্তর আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
স্থান-কাল ভেদে ট্রাইবরা কখনো জাতিতে (নেশন) উন্নীত হয় কি না? কিংবা জাতি কখনো ট্রাইব-এ পরিণত হয় কি না?
আপনি তো এখন বিদেশে আছেন। ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডনে তো অনেক বাঙালি (বাংলা ভাষাভাষি) স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তারা সেখানে কেবল বাঙালি, না বাংলাদেশি বাঙালি / ভারতীয় বাঙালি, না কি বাঙালি ট্রাইব (উপজাতি) নামে পরিচিত?
প্রশ্নটা অন্যভাবেও করা যায়, ভারতে তো একাধিক ট্রাইবাল (ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত) প্রদেশ এখনও বিদ্যমান। যেমন: মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম প্রভৃতি। অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্ত প্রদেশ থেকে প্র অব্যয়টি খসে গেলে এরা কি জাতিতে (নেশন) উন্নীত হয়ে যাবে?
এই ভূখণ্ডে বাঙালিরা শাসকশ্রেণী তো, তাই নিজের (সংকীর্ণ) অবস্থান থেকেই তারা সবকিছুকে দেখে এবং সংজ্ঞায়িত করে।
সাইদ ভাই, এ প্রসঙ্গে আমি আপনার further বক্তব্য প্রত্যাশা করছি।

আমার প্রত্যাশা ছিল, প্রিয় ব্লগার সাইদুর রহমান চৌধুরী (এবং আগ্রহী অন্য ব্লগাররাও) আলোচনাটি চালিয়ে যাবেন যাতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে মোটামুটি একটা উপসংহারে পৌঁছানো যায়। কিন্তু আলোচনাটি আর এগয়নি। হয়তো তিন-চার দিনের পুরনো পোস্ট বলে আমার শেষ মন্তব্যটি সবার, বিশেষ করে সাইদ ভাইয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তাই, সবার অংশগ্রহণের প্রত্যাশায় প্রাসঙ্গিক মন্তব্যগুলো কপি-পেস্টের মাধ্যমে নতুন পোস্ট আকারে উপস্থাপন করা। জানি না, আমার এই নতুন পোস্ট দেওয়ার ব্যাপারটাকে ব্লগাররা বাড়াবাড়ি বলে মনে করবেন কি না।

শুক্রবার, আগস্ট ১৩, ২০১০

'কক্সবাজারের দর্শনীয় স্থানসমূহ' এর 'মাথিনের কূপ, টেকনাফ' প্রসঙ্গে

দৈনিক রূপসীগ্রাম এর সূচনা সংখ্যার চাররঙা সাপ্লিমেন্টারি টেবলয়েডের লেখাগুলোয় চোখ বুলাচ্ছিলাম। এক জায়গায় (১৫-১৬ পৃষ্ঠায়) মং বা অঙের লেখা (উল্লিখিত শিরোনামের) দেখে আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু লেখাটির এক জায়গায় (মাথিনের কূপ, টেকনাফ উপ-শিরোনামের অংশে) এসে আমার মনে খটকা লাগল। সে অংশটুকু আমি এখানে হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ...চতুর্দশ বয়সী জমিদার কন্যা মাথিন ও ধীরাজ ভট্টাচার্যের নিখাদ প্রেমের ঐতিহাসিক নিদর্শন এ মাথিনের কূপ। গোত্র আভিজাত্যের প্রতিবন্ধকতায় ধীরাজ জমিদার মগ কন্যাকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হন। সুমধুর প্রেমের করুণ বিচ্ছেদে প্রেম সম্রাজ্ঞী তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করেন। এতে শাশ্বত অকৃত্রিম প্রেমের এক ইতিহাস বিরচিত হয়। মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের অমোঘ সাক্ষী মাথিনের কূপ।
লেখক মং বা অং তাঁর ঙারো রাখাইন গ্রন্থে মাথিনের কূপ প্রসঙ্গে ঠিক উল্টো কথাই লিখেছিলেন। আমি এখানে মং বা অঙের গ্রন্থ থেকে দুটো অংশ হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ...১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত টেকনাফের অন্যান্য পাতকূয়ার মতই এটি একটি সাধারণ পাতকূয়া ছিল মাত্র। টেকনাফের তরুণ সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস রানা ধীরাজ ভট্টাচার্যের ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনীর আলোকে ‘দুটি জীবনের মিলন ও বিচ্ছেদের সাক্ষী’ শিরোনামে ধীরাজ-মাথিনের প্রেম কাহিনী, অসম ও অতৃপ্তি প্রেমের নীরব সাক্ষী হিসেবে কূপটিকে বর্ণনা করে কূপের পাশে একটা সাইনবোর্ড টাংগিয়ে দেন। (পৃষ্ঠা ১৪৫)
...লাইলী-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট এর সত্য প্রেম কাহিনী নিয়ে নাটক, সিনেমা আছে, থাকবে এতে কারো দ্বিমত নেই। ধীরাজ-মাথিনের প্রেম কাহিনী যেখানে সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন সে কাহিনী নিয়ে টেলিফিল্ম নির্মাণ হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে তা সাধারণ পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। (পৃষ্ঠা ১৪৮)
এ ব্যাপারে মং বা অঙের সঙ্গে মুঠোফোনে আমি কথা বলেছি। তিনি জানালেন, মাথিনের কূপ নিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা ছাপা হয়নি, ছাপা হয়েছে কেবল ধীরাজ ভট্টাচার্যের কল্পকাহিনী।
এখন আমার প্রশ্ন, সম্পাদক কি একজন লেখকের বক্তব্যকে নিজের মতো উপস্থাপন করতে পারেন?

মং হ্লা প্রু পিন্টু
রামু, কক্সবাজার
maung.pintu@gmail.com

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ০৫, ২০১০

মহেশখালিতে ১০টি বধ্যভূমির সন্ধান

ক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালিতে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৯ বছর পর এই প্রথম বারের মতো নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের সার্বিক সহযোগিতায় ১০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব বধ্যভূমিতে চিরশায়িত আছেন '৭১ সালে রাজাকার-আলবদরের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া ৮৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মহেশখালিতে বধ্যভূমির শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরুই করা যায়নি। তৎকালীন শাসক দলীয় লোকজনের পরামর্শে স্থানীয় প্রশাসন মহেশখালিতে মুক্তিযোদ্ধার কোনো বধ্যভূমির অস্তিত্ব নেই বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর রিপোর্ট দিয়েছিল। অথচ সেই মহেশখালিতে একে-একে বেরিয়ে এসেছে ১০টি বধ্যভূমি এবং সেখানে চিরশায়িত মুক্তিকামী ৮৮ জন বীর শহিদের তালিকা, যেগুলো এতোদিন শনাক্তকরণের অভাবে অবহেলায় পড়ে ছিল। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ২৬ জুলাই কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক গিয়াস উদ্দিন ও মহেশখালির উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিএম কাউসার হোসেন এর উদ্যোগে শুরু হয় শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের বধ্যভূমি আবিষ্কার, সংরক্ষণ ও শহিদদের তালিকা তৈরির কাজ। এ লক্ষ্যে সহকারী কমিশনার (ভূমি)-কে আহ্বায়ক করে একটি বধ্যভূমি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। উক্ত টিম ২৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় গিয়ে অনুসন্ধান করে মোট ১০টি বধ্যভূমি আবিষ্কার করে। অনুসন্ধানে উঠে আসা ৮৮ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ১৩ জন মুসলমান, ৩ জন রাখাইন (একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ) এবং অবশিষ্ট ৬২ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ হিন্দু।

বিস্তারিত এখানে ~

মঙ্গলবার, মে ২৫, ২০১০

ইনানীর রহস্যময় 'কানা রাজার গুহা'


ক্সবাজারের 'কানা রাজার গুহা' দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে। জনশ্রুতি আছে যে, গুহাটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। তবে গুহাটির নেই কোনো সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণ। অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীরা গুহার মুখ ও আশপাশের পাথরগুলো উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পাহাড় ভেঙে গুহার মুখ অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে ঐতিহাসিক এ গুহাটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। গুহাটির মুখ প্রায় একশো বর্গফুট এবং গুহার দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। এ গুহা কীভাবে এবং কেনই-বা তৈরি করা হয়েছিল সে সব কাহিনী অজানাই রয়ে গেছে। ইনানী সমুদ্র সৈকত দর্শনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা হাতে সময় থাকলে রহস্যঘেরা এ গুহাটিও এক নজর দেখে যান।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন জালিয়াপালং। এই ইউনিয়নের ইনানী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরের কূলঘেষা পাটুয়ার টেকের সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে 'কানা রাজার গুহা'র অবস্থান। কক্সবাজারের লাবণী সী-বীচ থেকে এর দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটার। গুহাটির একেবারে কাছে যাওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই। অনেক কষ্ট করে গুহাটির কাছে গেলে শোনা যায় বানর আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এ সময় গা শিউরে ওঠে।
জেলে ও স্থানীয়দের মুখ থেকে 'কানা রাজার গুহা' নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। কানা রাজার আসল পরিচয় কী তা উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও এলাকায় জনশ্রুতি আছে যে, তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক শাসক। কিংবদন্তি আছে, প্রায় তিনশো বছর পূর্বে কানা রাজা তাঁর দলবলসহ আরাকান (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে পালিয়ে এসে পাটুয়ার টেকের পাহাড়ে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি একটি গুহা খনন করান। পরবর্তীতে এটি 'কানা রাজার গুহা' নামে পরিচিতি লাভ করে।
তিনশো বছর পূর্বে এখানকার একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সমুদ্র পথ। সেই সময় বঙ্গোপসাগরে দেশি-বিদেশি মালবাহী জাহাজ ও বিভিন্ন জলযান চলাচল করত। এ সব জলযান থেকে কর আদায় করতেন কানা রাজা। অনেকে তাঁকে সমীহ করে দিয়ে যেত মূল্যবান সামগ্রী। এ সব মালামাল গুহায় এনে রাখা হত। তাই অনেকের ধারণা, এ গুহায় এখনও অনেক মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে।
প্রায় একশো বছর পূর্বে স্থানীয় চাক সম্প্রদায়ের লোকজন পাহাড়ে জুম চাষ করার সময় এ গুহার সন্ধান পায়। পরবর্তীতে রহস্যঘেরা এ গুহা এক নজর দেখার জন্য আসতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের মতে, 'কানা রাজার গুহা'টি সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ গুহা।

মাদার বোর্ডের ওয়ারেন্টি সংক্রান্ত জটিলতা, অতঃপর সময় ক্ষেপণের গল্প

গত বছর জুনের শেষ দিকে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে আমার ক্লোন পিসিটা কেনা হয়েছিল কক্সবাজার শহরের বিলকিস শপিং কমপ্লেক্সস্থ দুই দোকান থেকে। সিপিইউটা এক দোকান থেকে এবং মনিটর আর মডেমটা অন্য দোকান থেকে। ডেস্কটপটির বিভিন্ন অংশের ওয়ারেন্টি ছিল এ রকম : প্রসেসর, মাদার বোর্ড ও হার্ডডিস্ক ড্রাইভের তিন বছর করে আর মনিটর, ডিভিডি রাইটার ও র‍্যামের এক বছর করে।
কেনার পর থেকে পিসিটা ঠিকমতো চলছিল। কিন্তু গত মার্চের মাঝামাঝি হঠাৎ বিগড়ে গেল পিসিটা। আমি সংশ্লিষ্ট দোকানের টেকনিশিয়ান (আমার প্রাক্তন ছাত্রীর ছোট ভাই)-কে দেখালাম। সব দেখে সে জানাল মূল সমস্যা মাদার বোর্ডের। তারা মাদার বোর্ডটি খুলে নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দিল গত ২৪ মার্চ এবং আমাকে জানাল সর্বোচ্চ পনেরো দিনের মধ্যে আমি মেরামত করা একই মাদার বোর্ড কিংবা বিকল্প নতুন মাদার বোর্ড পেয়ে যাব। কিন্তু দেড় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমি আমার পুরনো কিংবা নতুন মাদার বোর্ড কোনোটাই ফেরত পাইনি। এই দেড় মাস আমার লেখালেখি পুরোপুরি বন্ধই ছিল। এমন-কী 'রক্তের মলাটে একুশ' ই-বুক সংকলনের লেখাগুলোও যথাযথ সম্পাদনা করে পাঠাতে পারিনি।
মাদার বোর্ডটি ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে বারবার ধরনা দেওয়ার পর তারা আমাকে জানাল যে, ওই মাদার বোর্ডটি যে ডিলারের কাছ থেকে তারা কিনেছে সেই ডিলার সংশ্লিষ্ট ইম্পোর্টার ('কম্পিউটার সোর্স')-এর পাওনা পরিশোধ না করায় ইম্পোর্টার ওয়ারেন্টির শর্ত পালন করছে না। ফলে আমি পড়ে গেলাম গ্যাঁড়াকলে। স্থানীয় 'নিটা কম্পিউটার অ্যান্ড টেকনোলজি' থেকে পিসিটা কিনলে ওয়ারেন্টি সংক্রান্ত এমন জটিলতায় পড়তে হত না। কারণ, 'নিটা কম্পিউটার অ্যান্ড টেকনোলজি' ইম্পোর্টার 'কম্পিউটার সোর্স'-এর কক্সবাজারস্থ একমাত্র ডিলার (এটা কিন্তু তখন আমার জানা ছিল না)। আর যাদের কাছ থেকে আমি পিসিটা কিনেছিলাম তারা হল স্রেফ বিক্রেতা।
শেষ পর্যন্ত ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নগদ ৪ হাজার ৫৫০ টাকা দিয়ে ইন্টেলের ৪১ আরকিউ মাদার বোর্ডটি কিনলাম গত ১০ মে। সেটা দিয়েই এখন কাজ চালাচ্ছি। আচ্ছা, সংশ্লিষ্ট বিক্রতার কাছ থেকে আমি সেলস রিটার্ন অর্থাৎ ওয়ারেন্টির তিন বছর থেকে ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত সময় বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সময়ের টাকা (তখন ইন্টেলের ওই ৩১ পিআর মাদার বোর্ডটির দাম ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৬৫০ টাকা) ফেরত পাওয়ার দাবি করতে পারি কি না?

ইভটিজিঙের শিকার আরও এক ছাত্রী আত্মহননের পথ বেছে নিল

দেশে এখন অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ইভটিজিং। এটি এখন অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যাও। তাই মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন এবং একে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার পরও ইভটিজিং কিংবা এর শিকার মেয়েদের আত্মহনন বন্ধ হচ্ছে না। তাই অবক্ষয়ে নিমজ্জিত এই সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে শায়লা আক্তার তুলি (১৪)-কেও অভিমান নিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হল। আর তথাকথিত সভ্য সমাজের কাছে রেখে গেল চরম ঘৃণা।
বিস্তারিত এখানে
সভ্য সমাজ, সামাজিক জীব ইত্যাদি তকমাগুলো এখন ঠুনকোয় পরিণত হয়েছে। আমরা নিজেদেরকে সভ্য সমাজের একজন বা প্রকৃত অর্থে সামাজিক জীব কিংবা সৃষ্টির সেরা যদি দাবিই করি, তা হলে সামাজিক এসব অনাচারে আমরা বিচলিত হই না কেন কিংবা ঘরে-বাইরে এর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নিই না কেন?

একটি সংবাদ এবং এর নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

ক্সবাজার থেকে প্রকাশিত একটি প্রিন্ট মিডিয়ায় গত ২২ মে সংবাদটি প্রথম ছাপা হয়। এর পর কক্সবাজার থেকে পরিচালিত একমাত্র ওয়েব পত্রিকায় সেদিনই সংবাদটি হুবহু প্রকাশ করা হয় ওই প্রিন্ট মিডিয়ার সূত্রে। সংবাদটির সার কথা হল এই, কক্সবাজার শহরের বিশেষ-বিশেষ মহল্লায় বসবাসরত স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কতিপয় ছাত্রী (বোরকা পরা) হোটেল-মোটেল জোনে গিয়ে দেহব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা গেস্ট হাউজ খ্যাত আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফোনকল পাওয়ার পর সেখানে গিয়ে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে তথাকথিত সার্ভিস দিয়ে থাকে।
বিস্তারিত সংবাদ এখানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্রী (যাঁর বাড়ি কক্সবাজার জেলায়) আলোচ্য সংবাদটির অত্যন্ত তির্যক ও তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, যা সংশ্লিষ্ট ওয়েব পত্রিকায় গতকাল প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, উপযুক্ত তথ্য ও নির্ভরশীল সূত্রবিহীন ওই সংবাদটির কারণে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সাধারণ ছাত্রীরা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে ওই প্রিন্ট মিডিয়ার প্রকাশক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং ওয়েব পত্রিকারটির পরিচালকের জীবিকা অর্থাৎ মূল পেশার (শিক্ষকতা) ব্যাপারে প্রশ্ন রেখেছেন।
বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া এখানে
এখন আমারও মনে হচ্ছে, ওই প্রকাশক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরিচালকের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কন্যাসন্তান কিংবা নিকট-আত্মীয়া থাকলে সংবাদটি প্রকাশের আগে এর নেতিবাচক প্রভাব বা প্রতিক্রিয়ার কথা দ্বিতীয়বার ভাবতেন। তবে দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন এলাকা হিসাবে কক্সবাজার শহরে এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ যে একদম হচ্ছে না, তাও-বা বলি কী করে?
প্রতিক্রিয়ার জবাবে ওই প্রিন্ট মিডিয়ার জবাবটি পড়ুন এখানে

মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০১০

ভাষার মাসে শুদ্ধ বাংলা চর্চার ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ

ছর ঘুরে আবার এল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। যদিও রক্তের বিনিময়ে এই ভূখণ্ডে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে মর্যাদাসীন হয়েছে বাংলা ভাষা এবং সেই আত্মত্যাগের দিনটিই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে আমরা ক'জন শুদ্ধ বাংলা লিখি ও বলি?
সাইনবোর্ড, ব্যানার, প্রতিষ্ঠানের দাফ্তরিক চিঠি, পত্র-পত্রিকা, বাংলা ব্লগ, পাঠ্য বই ও নাটক-সিনেমায় পাত্র-পাত্রীর সংলাপে বাংলা বানানের যথেচ্ছাচার ও গুরুচণ্ডালি ইদানীং খুব বেশি চোখে পড়ে ও কানে বাজে। ব্যাকরণ মেনে চললে এ রকমটি হওয়ার কথা নয়। যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁদের অবশ্যই প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করতে হবে।
একজন বিশেষ পরিচালকের নাটক-সিনেমায় পাত্র-পাত্রীদের নয় সাধু-নয় চলিত রীতির ক্রিয়াপদের সংলাপ (যেমন : বলতেছি, করতেছি, আসতেছি ইত্যাদি) আওড়ানো দেখে ও শুনে আসছি গত প্রায় এক দশক ধরে। ইন্টারনেট জগতের নব সংযোজন বিভিন্ন বাংলা ব্লগে কতিপয় ব্লগার প্রচলিত শব্দগুলো বিকৃত বানানে (যেমন : কর্ছে, মঞ্চায়, আম্রা ইত্যাদি) লিখে যেন নিজেদের বিকৃত মানসিকতাকেই প্রকাশ করছেন।
সবার প্রতি আমার আহ্বান, আসুন এই ভাষার মাসে আমরা শুদ্ধ বাংলা লিখতে সচেষ্ট হই অর্থাৎ প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করি। অতএব প্রিয় ব্লগার, এই এক মাস আমরা লেখা বা পোস্ট প্রকাশের আগে বানানগুলো আর একবার দেখে নিই, প্রয়োজন মনে করলে কিংবা কোনো শব্দের বানান নিয়ে সন্দেহ থাকলে বাংলা-বাংলা অভিধানের শরণাপন্ন হই।

মঙ্গলবার, জানুয়ারী ২৬, ২০১০

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও তার কর্মী বাহিনী

ব্যক্তি মানুষকে স্বাতন্ত্র্য করে তোলে তার আদর্শ। এটা সবার বেলায় প্রযোজ্য। এটা সামষ্টিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আদর্শবান মানুষ কখনো আপোশ করেন না বা করতে পারেন না। আদর্শবান মানুষকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, তিনি যদি আমার বিরুদ্ধাচারী কিংবা ভিন্নমতাবলম্বীও হন তা হলেও।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটা আদর্শ নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এখন আমার প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য কি শুধুই ক্ষমতায় যওয়া? পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে আমাদের দলীয় সরকারগুলো দেশকে কতটুকু এগিয়ে নিয়েছে বা নিতে পেরেছে?
আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল চালিকা শক্তি তার কর্মী বাহিনী। দলীয় কর্মীদের মধ্যে যাঁরা স্বীয় দলের গুণগান করেন তাঁরা দলীয় আদর্শকে কতটুকু বুকে ধারণ করেন? আমার মনে হয় না যে, তাঁরা আদর্শের কারণে দলীয় রাজনীতি করেন।
আমার এই বয়সে আমি যা দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক কর্মী সংকীর্ণ (ব্যক্তি) স্বার্থেই (এটা হতে পারে নিজের বা পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখা, দলের প্রভাব খাটিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা, মোট কথা নিজের আখের গোছানো) রাজনীতি করেন। আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করলে ক্ষমতার পালা বদলের সময় লেবাস পরিবর্তনের ঘটনা এত বেশি ঘটত না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মীরই আদর্শের কোনো বালাই নেই। যদি থাকত, তা হলে স্বাধীনতার এই আটত্রিশ বছরে আমাদের অর্জন চোখে পড়ার মতো হত।

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ২১, ২০১০

প্রসঙ্গ : দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসাবে গত সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বেতার-টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত ভাষণে বলেছিলেন যে, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছরকে টার্গেট করে সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। সে জন্য তিনি ভিশন ২০২১-এর কথা বলেছিলেন।
নির্বাচনের অব্যবহিত পরে সরকার গঠনের সময় মন্ত্রী পরিষদে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও নতুন মুখ দেখে নির্দলীয় আমরাও আশাবাদী হয়েছি যে, ৩৭ বছর বয়সী বাংলাদেশকে এঁরাই গতি দেবেন এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বর্তমান সরকারের গৃহীত এ পর্যন্ত পদক্ষেপের কারণে সচেতন জনগণের আশাভঙ্গের তেমন কিছু ঘটেছে বলে আমার মনে হয়নি। তবে দুর্নীতি দমন, নির্মূল কিংবা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের কোনো পদক্ষেপ বা কার্যক্রমই চোখে পড়ছে না। আজ একটি দৈনিকের খবর পড়ে দুর্নীতি মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে আমার মনে ক্ষীণ হলেও একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দুর্নীতির ব্যাপারে এখনই কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা প্রিয় স্বদেশভূমির যে রূপ দেখব, তা কি এখনকার বাংলাদেশ থেকে ভিন্নতর কিছু হবে?

রবিবার, জানুয়ারী ১০, ২০১০

নির্বাচন ও সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে মানসিকতা ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তন চাই

বিগত শতকের আশির দশক থেকে বাংলাদেশের যে-কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে (স্থানীয় সরকারের নিম্ন স্তর অর্থাৎ ইউপি নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আর সরকারি চাকরির প্রার্থী হওয়াকে (যেমন : পুলিশ ও কাস্টমসের চাকরি, জেলা প্রশাসনের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি, সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য সহকারীর চাকরি ইত্যাদি) সংশ্লিষ্টরা এক ধরনের বিনিয়োগ মনে করে। কারণ, এসব ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় কিংবা লাখ-লাখ টাকা লেনদেন ছাড়া নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া কিংবা চাকরি নামক সোনার হরিণটিকে ধরা যায় না। নির্বাচন বলুন আর চাকরিই বলুন প্রার্থীর প্রধান যোগ্যতা টাকা খরচ করার ক্ষমতা, যাকে আমরা বলে থাকি টাকার খেলা।
নির্বাচনে জেতার পর ওই জনপ্রতিনিধি তাঁর বিনিয়োগকৃত অর্থের গুণিতক পরিমাণ টাকা তাঁর ক্ষমতার মেয়াদে তুলে আনতে সচেষ্ট থাকেন (এটা হতে পারে কমিশন খেয়ে, নগদ প্রাপ্তির বিনিময়ে সুপারিশ করে, ভুয়া প্রকল্প বরাদ্দ দিয়ে, নিজের বা দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদা তুলে ইত্যাদি)। আর চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি নামক সোনার হরিণটি হাতে পাওয়ার পর তাঁর প্রদত্ত ঘুসের টাকা সুদে-আসলে তুলতে শুরু করেন (যেমন : পুলিশের ক্ষেত্রে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে, কাস্টমসের ক্ষেত্রে সরকারি কোষাগারকে তলানিতে নামিয়ে)। এ ক্ষেত্রে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সংবাদ শিরোনাম হওয়া কোটিপতি কিংবা একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক পিডিবি, বাখরাবাদ কিংবা তিতাস গ্যাস লিমিটেডের মিটার রিডারদের নাম স্মরণ করা যেতে পারে।
যাঁরা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা (শিক্ষাগত ও চারিত্রিক) ছাড়া নির্বাচনে জেতেন কিংবা সরকারি চাকরি পান তাঁদের কাছ থেকে সাধারণ জনগণ কোনো পরিষেবা পায় না, পায় শুধু হয়রানি। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাবলে উতরিয়ে আসা জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণকে ঠিকই পরিষেবা দেন।
এবার মডেল থানা প্রসঙ্গ। আমার নিজ জেলার সদর থানাটি একটি মডেল থানা। একে কেন মডেল থানা বলা হল আমি ঠিক জানি না। মাসে দু-একটি ওপেন ডে অনুষ্ঠান করলেই মডেল থানা হয়ে যায়? কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত (যেহেতু ওসি পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয় না) স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় (কোনো রকম ঘুস ছাড়া) নিয়োগ দিয়ে তাঁদেরকে মডেল থানায় পোস্টিং দেওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট থানাগুলো গুণগত মান পরিবর্তিত হয়ে মডেল থানায় রূপান্তরিত হবে, অন্যথায় নয়। কারণ, ঘুস ছাড়া চাকরি পাওয়া পুলিশ পরিষেবার বিনিময়ে ঘুস চাইবেন না।

শিক্ষকতা কি কেবলই জীবিকা?

তাঁরা চাকরিপ্রার্থী। তাই তাঁরা নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় পত্রিকার খবর অনুযায়ী তাঁরা যে উপায় অবলম্বন করেছেন তা প্রশ্নাতীতভাবে অসৎ।
তাঁরা যে পেশার জন্য নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন, উন্নত বিশ্বে ওই পেশাকে শ্রেষ্ঠ পেশা হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পেশাটা হচ্ছে মানুষ গড়ার পেশা। যদিও তৃতীয় বিশ্বে পেশা আর জীবিকাকে আলাদা করে দেখার তেমন প্রবণতা নেই। তবু মানুষ গড়ার পেশাটাকে কেবলই জীবিকার উপায় মাত্র ভাবলে চলবে না। এর সঙ্গে আদর্শ, সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি অন্যান্য জীবিকার তুলনায় বেশি মাত্রায় জড়িত।
সুতরাং, যাঁরা জীবিকার জন্য যেনতেন প্রকারে একটা চাকরি চান, তাঁরা এই পেশার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে ভূলুণ্ঠিতই করে বসবেন। কারণ, এই মহান পেশায় ফাঁকতালে ঢুকে পড়া মানুষ গড়ার তথাকথিত কারিগরদের হাত দিয়ে প্রখর নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন ভবিষ্যৎ নাগরিক না বেরিয়ে কেবল সনদধারী তথাকথিত তারকাই বেরুতে থাকবে।
বর্তমান সরকার ঘোষিত ভিশন ২০২১-এর আলোকে সরকারের শিক্ষা-সংস্কার সংক্রান্ত চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের উচিত শিক্ষকতা পেশার এই দিকটি ভেবে দেখা। কারণ, এর প্রভাব সুদূর প্রসারী।